Monday , May 20 2024
Breaking News
Home / Exclusive / সেই ফারদিনের উপর নিষেধাজ্ঞা, যাঁকে বাঁধা দেননি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও

সেই ফারদিনের উপর নিষেধাজ্ঞা, যাঁকে বাঁধা দেননি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও

২ এপ্রিল ২০১৫ রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অষ্টম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসের কর্মসূচি চলছিল। মঞ্চে বসে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য অতিথিরা। এ সময় মঞ্চের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন এক প্রতিবন্ধী যুবক। নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে থামানোর চেষ্টা করলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ও হাঁটছে, ওকে হাঁটতে দেন।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিনা বাধায় মঞ্চের সামনে দিয়ে হাঁটতে দেওয়া হয় এমরান হোসেন ফারদিনকে। প্রতিবন্ধী ফারদিনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ঘটনা নিয়ে প্রথম আলোতে ‘ও হাটছে, ওকে ওখানে হাটতে দাও: প্রধানমন্ত্রী’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিলো।

৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ সন্ধ্যায় ফারদিন তার মা জেসমিন মোশাররফের সাথে রাজধানীর উত্তরার সেক্টর ১১ পার্কে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ২৮ বছর বয়সী এই প্রতিবন্ধী ব্যক্তি পার্কের বেঞ্চে বসা এক মহিলার হাত ধরেছিলেন। কিন্তু এ কথা মেনে নিতে পারেননি ওই নারী। এ ঘটনায় তিনি ক্ষুব্ধ হন।

ফারদিনের মা জেসমিন তখন মহিলাকে বোঝাতে চান যে তার ছেলে প্রতিবন্ধী। খারাপ কিছু ভেবে হাত টানেনি। কিন্তু সেই মহিলার রাগ কমানো গেল না। পরে তিনি ১১ নম্বর সেক্টর ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সহ-সভাপতি রফিকুল ইসলামকে বিষয়টি জানান। তিনি অভিযোগ করেন, এক যুবক (ফারদিন) তাকে শ্লীলতাহানি করেছে। তিনি লিখিতভাবে অভিযোগও করেছেন।

এরপর রফিকুল ইসলাম ফারদিন ও তার মা জেসমিনকে আটক করে একটি অঙ্গীকারে জেসমিনের স্বাক্ষর নেন। এতে বলা হয়েছে, ফারদিন ও জেসমিন আর কখনোই এই পার্কে প্রবেশ করতে পারবে না।

জেসমিন মোশাররফ অভিযোগ করেন, অঙ্গীকারে স্বাক্ষর করা ছাড়াও তাকে ও তার ছেলেকে পুলিশে সোপর্দ করার হুমকি এবং ফারদিনকে বাথরুমে আটকে রাখাসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়।

ঘটনার ১১ দিন পর গত মঙ্গলবার পার্কটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা ওয়েলফেয়ার সোসাইটি বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নেয়। বৈঠকে অভিযুক্ত নারী ও তার স্বামী রফিকুল ইসলাম ঘটনার জন্য ফারদিনের বাবা-মায়ের কাছে মৌখিকভাবে ক্ষমা চান।

গত বৃহস্পতিবার ফারদিনের মা জেসমিন ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘ছেলেকে নিয়ে ১১ নম্বর পার্কে হাঁটছিলাম। ছেলে অটিস্টিক। ডায়াবেটিস আছে। আমাদের বাড়ি ১০ নম্বর সেক্টরে, কিন্তু সেখানে কোনো পার্ক না থাকায় আমি আমার ছেলেকে সেই পার্কে বেড়াতে নিয়ে যাই। সেদিন ছেলেটি বেঞ্চে বসা একটি মেয়ের হাত ধরেছিল। এ অপরাধে সাদা কাগজে সই করতে বাধ্য করা হয় আমাকে। ওই অঙ্গীকারনামায় টাইপ করে লেখা হয়েছে, আমি ছেলেকে নিয়ে আর পার্কে হাঁটতে যেতে পারব না। আমার জীবনে এখন পর্যন্ত এটিই সব থেকে দুঃখজনক ঘটনা।

জেসমিন আরও বলেন, ‘সেদিন খুব গরম ছিল। ফারদিন অস্থির হয়ে পড়ছিলো। তাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমিও বারবার কর্তিপক্ষের কাছে অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তারা আমাদেরকে পুলিশে সোপর্দ করে আমাদের ছেলেকে বাথরুমে তালা দিয়ে আটকে রাখার হুমকি দিতে থাকে। তখন আমি বললাম, আমার ছেলেকে বাথরুমে আটকানোর দরকার নেই। বরং তার অপরাধের জন্য তাকে ফাঁসি দিন।

ফারদিনের বাবা চিকিৎসক এ কে এম মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, “আমার ছেলের হাত ধরেছিল, সে একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট। একজন মেডিকেল স্টুডেন্টের অটিজম সম্পর্কে কোনো ধারণাই থাকবে না, সেটা কেমন।সরকার অটিজম সচেতনতায় কত কিছু করছে। আমার ছেলে–স্ত্রীর এভাবে অপমানিত হওয়ার ঘটনা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।

ফারদিনের মা জেসমিন বলেন, ‘অটিস্টিক বাচ্চার বাবা–মায়েরা শখ করে তো সন্তানদের নিয়ে হাঁটতে যান না।। তারাও এদেশের নাগরিক। তাদেরও অধিকার আছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও তাকে হাঁটতে বাধা দেননি। এখন অঙ্গীকারনামা দিতে হয় যে ছেলেকে নিয়ে পার্কে যেতে পারব না।

যা আছে অঙ্গীকারে

লিখিত অভিযোগে সম্পর্কে ওই নারীর স্বামী জানান, অপরিচিত এক ব্যক্তি তার স্ত্রীর হাত চেপে ধরে। তাকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। তিনি এ ঘটনার বিচার চান। উপরোক্ত লিখিত অভিযোগে অভিযুক্ত যুবক মানসিক ভারসাম্যহীন। তিনি প্রায়ই পার্কে হাটতে আসে। ভবিষ্যতে যাতে সে এই পার্কে না আসে সে জন্য তাকে অঙ্গীকার নিয়ে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়।

রফিকুল ইসলাম সোসাইটির সহ-সভাপতি অঙ্গীকার নামায় উপরাষ্ট্রপতির নীল কালির সিল ব্যবহার করা হয়েছে। ফারদিনের মা–বাবার অভিযোগের বিষয়ে জানতে এই প্রতিবেদক তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন।  কিন্তু তাকে মোবাইল ফোনে কল-মেসেজ করেও সাড়া পাওয়অ যায়নি।

সোসাইটির সভাপতি আলতাফ হোসেন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, এটা খুবই দুঃখজনক যে সহ-সভাপতি অতি উচ্ছৃঙ্খল কাজ করেছেন। এতে আমরা লজ্জিত। তিনি এভাবে সাদা কাগজে প্রতিশ্রুতি নিতে পারেন না। ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং অভিযোগকারী মহিলা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর ঘটবে না বলেও প্রতিশ্রুতি দেন সহ-সভাপতি।

অঙ্গীকারের বিষয়ে ফারদিনের বাবা বলেন, আমার ছেলে কথাও বলতে পারে না। যে কেউ অটিস্টিক শিশুদের দেখে এটি বুঝতে পারে। কিন্তু অভিযোগকারী ওই নারী ও সমাজের সহ-সভাপতি তা বুঝতে পারেননি। সে একটি সাদা কাগজে আমার স্ত্রীর স্বাক্ষর নিয়ে তাতে বানোয়াট অশ্লীল কথা লিখেছিল। আমার ছেলে অপরাধী নয়, তবুও তার সাথে এমন আচরণ করা হয়েছে।

ব্যক্তির আইনগত অধিকার

২০১৩ সালে, সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করে। শারীরিক অবকাঠামো, যানবাহন, যোগাযোগ, তথ্য প্রযুক্তি সহ জনসাধারণের জন্য উপলব্ধ সমস্ত সুযোগ-সুবিধা এবং পরিষেবাগুলিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমান সুযোগ এবং অন্যদের মতো সমান আচরণের অধিকার রয়েছে।

আইনে বলা হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি সুবিধা, পার্ক, স্টেশন, বন্দর, টার্মিনাল, রাস্তাসহ সব সরকারি সুবিধায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া সংক্ষুব্ধ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিজে বা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পিতা-মাতা, আইনগত বা আইনগত অভিভাবক বা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংগঠন এই আইনের অধীনে সংঘটিত যেকোনো অপরাধের জন্য মামলা করতে পারবেন।

প্রতিবন্ধী শিশুকে পার্কে ব্যবহার করতে না দেওয়া ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা চেয়ে রিট

আদালত পর্যন্তও গড়িয়েছে।

গত ২৬ এপ্রিলের ঘটনা। মেয়ে আল আয়মান ইয়ানাতকে নিয়ে রংপুর নগরের চিকলি ওয়াটার পার্কে যান রিজা রহমান। কিন্তু পার্কের কিডস জোনে হুইলচেয়ারে মেয়েসহ ঢুকতে গেলে তাঁকে বাধা দেওয়া হয়। ইয়ানাত সেরিব্রাল পালসি নামের মস্তিষ্কের পক্ষাঘাতের মতো এক রোগে আক্রান্ত।

এ ঘটনার প্রতিবাদে পরদিন ২৭ এপ্রিল রিজা রহমান রংপুর জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। অভিযোগে তিনি ওই পার্কসহ বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রে হুইলচেয়ার নিয়ে যাতে যাওয়া যায়, এ ধরনের একটি নির্দেশিকা টানিয়ে রাখারও আহ্বান জানান।

৩ মে মেয়েকে নিয়েপুর প্রেসক্লাবে সংবাদ প্রকাশ করে তার মেয়ের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে এ প্রতিবাদ জানান রিজা রহমান। ২১ মে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইনের অধীনে পার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না—তা জানতে চেয়ে রুল দেন হাইকোর্ট। টেবিল পার্কে ইয়াকে ঢুকতে না  দেওয়ার জন্য বিশেষ আদালতে রিট আবেদন করে দুই আইনজীবী।

About Nasimul Islam

Check Also

লোভে পড়ে নিজের ভাইকে বিয়ে করলেন বোন, নেট দুনিয়া তোলপাড়

ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যে টাকার জন্য প্রীতি যাদব নামের এক নারী তার ভাইকে বিয়ে করেছেন। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *