Monday , May 20 2024
Breaking News
Home / Countrywide / ‘দুই কোটি টাকা দিয়ে পোস্টিং নিয়েছি, ঘুস না নিলে টাকা তুলব কীভাবে?’

‘দুই কোটি টাকা দিয়ে পোস্টিং নিয়েছি, ঘুস না নিলে টাকা তুলব কীভাবে?’

দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে কক্সবাজারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। টেন্ডারের গোপন রেইট ফাঁস, নিজস্ব ঠিকাদার দিয়ে কাজ ভাগিয়ে নেওয়া, ঘুস গ্রহণ, কমিশন বাণিজ্য, টেন্ডার নিয়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে এখানকার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কক্সবাজার সফরকে ঘিরে জরুরি কাজ দেখিয়ে তিনবার টাকা আত্মসাৎ করেন। আর এই ঘুষ-দুর্নীতির পক্ষে যুক্তিও দেন তিনি। বলেন, ‘দুই কোটি টাকা দিয়ে পোস্টিং নিয়েছি, ঘুস না নিলে ওই টাকা তুলব কীভাবে?’

অনিয়ম-দুর্নীতির সুবিধার্থে এই কর্মকর্তা সহকারী ক্যাশিয়ার গৌতম কুমার পাল ও হিসাবরক্ষক রাজীব হোসেন রাজুকে তার সাবেক কর্মস্থল চুয়াডাঙ্গা থেকে কক্সবাজারে বদলি করেছেন। এখন তারাই ঠিক করে দেন, কে কত টাকার টেন্ডারের রেইট দেবে এবং কোন ঠিকাদার কোন কাজটা পাবেন। এ নিয়ে মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে দুদক, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী ঠিকাদার সোহেল জাহান চৌধুরী এবং কক্সবাজারের সচেতন নাগরিক কমিটি নামের একটি সংগঠন। অভিযোগে স্বাক্ষর করেন সংগঠনের সভাপতি অজিত দাস ও সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান।

যত অভিযোগ মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে :

কক্সবাজারের নয়টি উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য স্যানিটেশন এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ইএমসিআরপি প্রকল্প, রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং প্রকল্প, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্যানিটেশন, গভীর নলকূপ, টয়লেট, পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ওয়াটার রিজার্ভার স্থাপন প্রকল্প থেকে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে মোস্তাফিজুর সিন্ডিকেট। এ ছাড়াও আরএফকিউ টেন্ডারে কোনো প্রকার নোটিশ ছাড়া নিজস্ব ঠিকাদারের লাইসেন্স ব্যবহার করে কাজ করানো, টেন্ডার ছাড়া গুদামের মাল বিক্রি, ভুয়া কাজ দেখিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে আর বিরুদ্ধে। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, মোস্তাফিজুর রহমান মোটা অঙ্কের ঘুস দিয়ে ২০২২ সালের আগস্ট মাসে কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে যোগ দেওয়ার পর থেকে ওই টাকা তুলতে বেপরোয়া হয়ে ঘুসবাণিজ্য, টেন্ডারবাণিজ্য ও কমিশনবাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ঠিকাদার ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের কথায় কথায় হাঁকডাক দিয়ে বলেন, ‘দুই কোটি টাকা দিয়ে পোস্টিং নিয়েছি, ঘুস না নিলে টাকা তুলব কীভাবে?’

কায়েজন ঠিকাদারের মতে, বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ পরিশোধের জন্য বিল তৈরি করে জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসে পাঠানো হয়। নিয়মানুযায়ী, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো হিসাব অফিস থেকে চেক গ্রহণ করবে। তবে নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান তার অনিয়মিত সহযোগী ক্যাশিয়ার গৌতম কুমার পালের মাধ্যমে কমিশনের নামে ঠিকাদারের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন।  পছন্দের ঠিকাদারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের উৎকোচ নিয়ে ২০ ভাগ কাজ করিয়ে ৮০ ভাগ অগ্রিম বিল পরিশোধ করেন। এ ছাড়াও কাজের কার্যাদেশ প্রদানের জন্য অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্যানিটেশন প্রদানের লক্ষ্যে কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে ইএমসিআরপি প্রকল্পের অধীনে এক হাজার ৮০০ গভীর নলকূপ, আট হাজার ৮০০ টয়লেট, এক হাজার বায়োফিল টয়লেট, গ্রামীণ পাইপড ওয়াটার সাপ্লাই স্কিম ৩১টি এবং ২০টি পাবলিক টয়লেট স্থাপন করা হচ্ছে। এবং কক্সবাজার জেলার নয়টি উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের বিশুদ্ধ পানি ও টয়লেট বসানো হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী গভীর নলকূপ স্থাপনের জন্য ৯০০ ফুট থেকে এক হাজার ফুট বোরিং করার কথা থাকলেও ৭০০ ফুট থেকে ৭৫০ ফুট করা হচ্ছে। নলকূপে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান বা যুক্তরাজ্য থেকে ৬০ হাজার টাকার সাবমারসিবল পাম্প দেওয়ার কথা থাকলেও দেশীয় ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার পাম্প দেওয়া হচ্ছে। এসব টিউবওয়েলের পানি ও পাম্প বুয়েটের ল্যাবে পরীক্ষা করার কথা থাকলেও সেখানেও প্রতারণা করা হয়েছে। বেশ কয়েকটি কূপ জলের কূপ পরীক্ষা করে রিপোর্ট করা হয়েছে। কিন্তু সুবিধাভোগীরা অভিযোগ করেছেন, অনেক নলকূপের পানিতে অতিরিক্ত আয়রন, লবণ, আর্সেনিক ও ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায় এবং অনেক নলকূপের গভীরতা অগভীর থাকায় গ্রীষ্মকালে পানি পাওয়া যায় না।

রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং প্রকল্পেও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। চাকরির বিবরণের বিওসি ভালো কোম্পানির ট্যাংক দেওয়ার কথা থাকলেও তা মানা হয়নি।দেওয়া হয়েছে নিুমানের পানির ট্যাংক। ঠিকাদারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুস নিয়ে ২০ ভাগ কাজ করা হলেও দেওয়া হয়েছে ৮০ ভাগ বিল। ফলে কার্যাদেশের মেয়াদ শেষ হলেও শেষ হয়নি বেশির ভাগ কাজ।

জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গুদাম পরিষ্কার করার জন্য পরিত্যক্ত পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রেও সরকারি নিয়ম মানা হয়নি। টেন্ডারের মাধ্যমে পণ্য বিক্রির নিয়ম থাকলেও তা করা হয়নি। এস্টিমেটর রাজীব হোসেন রাজুর মাধ্যমে কোন প্রকার নোটিশ বা কোটেশন ছাড়াই নিজের লোকজনের মাধ্যমে মোটা কমিশন দিয়ে মালামাল বিক্রি করা হয়। এতে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সফর ঘিরে কোটি টাকা আত্মসাৎ :

অভিযোগ আছে, রাষ্ট্রপ্রতি ও প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজার সফর ঘিরে কক্সবাজার জনসাস্থ্য অধিদপ্তরের স্টাফ কোয়ার্টার মেরামতের বরাদ্দ এনে কাজ না করে বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। সূত্রমতে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে কক্সবাজারে প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে জরুরি কাজ দেখিয়ে ২৪ লাখ টাকা, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি কক্সবাজার সফরকালে জরুরি কাজ দেখিয়ে ২৯ লাখ টাকা এবং ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রীর কক্সবাজার সফরকালীন জরুরি কাজ দেখিয়ে ২১ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান। এ ছাড়াও ২০২৩ সালে দুর্যোগকালীন সময়ে তিন উপজেলায় সাইক্লোন শেল্টার মেরামতের কাজ দেখিয়ে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।

নিজস্ব ঠিকাদারদের কাজে আনার অভিযোগ :

বিভিন্ন জেলা থেকে নিজস্ব ঠিকাদার এনে সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন মোস্তাফিজুর রহমান। তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের কমিশন নিয়ে দরপত্রের গোপন হারের কথা জানান মোস্তাফিজুর রাজীব হোসেন রাজুর মাধ্যমে। এরপর তাদের কাজের মাধ্যমে নিুমানের সামগ্রী ব্যবহার ও অনিয়মের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন মিলেমিশে। সম্প্রতি নবগঠিত ঈদগাঁও উপজেলায় নিরাপদ পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন, ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের দরপত্রে বড় ধরনের দুর্নীতি করা হয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য নয়। দুই কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে কক্সবাজারে এসেছি। তিনি বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে তারা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছে। মোস্তাফিজুর আরও বলেন, আজ ভালো কাজ করতে গিয়ে ষড়যন্ত্রের মুখে পড়তে হচ্ছে।

About Nasimul Islam

Check Also

অবন্তিকার পর এবার একই পথে হাঁটল মীম

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আ/ত্মহত্যা করেছে। শিক্ষার্থীর নাম শারভীন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *