রাজনীতি, আইন, প্রশাসনসহ দেশের প্রায় সকল বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে যখন একের পর এক দূর্নীতির চিত্র প্রতীয়মান হচ্ছে তখন এই প্রভাববলয় থেকে মুক্ত থাকতে পারলোনা অপরাধীদের থাকার জায়গা তথা কারাগারও।
কেন্দ্রীয় ও জেলা মিলে ৮টি কারাগার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা একযোগে মসুর ডাল সরবরাহে বড় ধরনের জালিয়াতি করেছেন বলে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। স্থানীয় তালিকাভুক্ত ঠিকাদারের বাইরে ঢাকার একজন ভুসি ব্যবসায়ীকে বাজারমূল্যের নামে উচ্চমূল্যে মসুর ডাল সরবরাহের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ঠিকাদারি কাজ পাওয়ার জন্য জমা দেওয়া বেশিরভাগ কাগজপত্র জাল। এমনকি পারফরম্যান্স ব্যাংক গ্যারান্টি নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। অথচ ব্যাংক সার্টিফিকেটসহ জাল কাগজপত্র যাচাই করে দেখেনি দায়িত্বশীল কেউ। এ বিষয়ে গঠিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের হাইপাওয়ার তদন্ত কমিটির রিপোর্টে এ রকম চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে। জড়িত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে অধিকতর তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
এদিকে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর অধিকতর তদন্তে দুদক থেকে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সুরক্ষা সেবা বিভাগের বিস্তারিত তদন্ত প্রতিবেদনে অনেক কিছুই বেরিয়ে এসেছে। অভিযুক্তদের চিহ্নিত করাসহ তদন্ত প্রতিবেদনটি অনেক শক্তিশালী। তবে এখন বিষয়টি দুদকের বিধিবিধানের ফরমেটে এনে অধিকতর তদন্ত করা হচ্ছে।
তদন্ত প্রতিবেদনের মতামতে বলা হয়েছে-মূলত এখানে একটি সিন্ডিকেট কাজ করেছে। যার মাধ্যমে সিপিটিউ (সেন্টার প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট) সিস্টেমে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড গ্রহণের বিষয়টি পেন্ডিং রোধে একদিকে ১ম সর্বনিম্ন দরদাতা ঠিকাদারকে নির্ধারিত মূল্যে কারাগারসমূহে ডাল সরবরাহ না করার অজুহাত সৃষ্টি করা হয়। অপরদিকে একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সরাসরি মসুর ডাল কিনতে বাধ্য করা হয়েছে। এর ফলে সরকারকে আর্থিকভাবে সম্মুখীন হতে হয়েছে।
সরাসরি ক্রয়-প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে পিপিআর-২০০৮ এর বিধি ৭৪(১)(২)(৩) ও (৪), ৭৫(৩), ৭৬(ঙ) ও ১২৭ (২.গ)-তে বর্ণিত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বিধানসমূহ উপেক্ষিত করা হয়েছে। প্রত্যেক কারাগারের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার, পূর্বের মেয়াদে ডাল সরবরাহকারী ঠিকাদার যারা দুঃসময়ে কমমূল্যে অতিরিক্ত মসুর ডাল সরবরাহ করেছেন, এমনকি ই-জিপি (ইলেকট্রনিক গভর্মেন্ট প্রকিউরমেন্ট) প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী ঠিকাদারদের সবাইকে বাদ দিয়ে জালজালিয়াতির কাগজপত্র সৃষ্টি করে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান হানিফ এন্টারপ্রাইজকে কাজ দেওয়া হয়েছে। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৭৫ টাকা কেজিদরে মসুর ডাল কেনার ক্ষেত্রে পিপিআর-২০০৮ এর বিধি লঙ্ঘন করা হয়। এটি করতে গিয়ে বিধি মোতাবেক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াই ঠিকাদার নির্বাচন করা হয়, যা দুরভিসন্ধিমূলক, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং আর্থিক দুর্নীতির শামিল।
তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা হলেন, কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার ১ ও ২-এর সাবেক সিনিয়র জেল সুপার এবং কারা অধিদপ্তরে কর্মরত রত্না রায়, চট্টগ্রাম কারাগারের সাবেক সিনিয়র জেল সুপার এবং বর্তমানে সিলেটে ভারপ্রাপ্ত ডিআইজি পদে কর্মরত কামাল হোসেন, যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের সাবেক সিনিয়র জেল সুপার এবং বর্তমানে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে কর্মরত সুব্রত কুমার বালা, গাজীপুরের সাবেক জেল সুপার এবং বর্তমানে কক্সবাজারে কর্মরত মো. নেছার আলম, নরসিংদীর সাবেক জেল সুপার এবং বর্তমানে মাদারীপুরে কর্মরত নজরুল ইসলাম, দিনাজপুরের সাবেক জেল সুপার এবং বর্তমানে গাজীপুরে কর্মরত বজলুর রশীদ আখন্দ, কক্সবাজারের সাবেক জেল সুপার এবং বর্তমানে দিনাজপুরে কর্মরত মোকাম্মেল হোসেন। এছাড়া কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শাহজাহান আহমেদ।
এছাড়া এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত রয়েছে সিপিটিইউ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (সর্বনিম্ন দরদাতার কাছে পণ্য সরবরাহের জন্য প্রস্তাব) গ্রহণ না করা সর্বনিম্ন দরদাতারা। পিপিআরের বিধি মোতাবেক সতর্কমূলক নির্দেশনা অনুসরণ এবং সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া দর প্রস্তাব উপস্থাপনের সঙ্গে জড়িত কারা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও দায় এড়াতে পারবেন না।
সূত্র জানায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে গঠিত ২ সদস্যের তদন্ত কমিটি ২৩ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দেয় গত ২৭ জুন। কমিটির অপর সদস্য মন্ত্রণালয়ের অগ্নি-১ শাখার একজন উপসচিব। জুলাই মাসে তদন্ত প্রতিবেদনটি দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠানো হয়। দুদক এখন অধিকতর তদন্তের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে গত ২৯ ডিসেম্বর এ বিষয়ে কিছু তথ্য জানতে চেয়ে কারা প্রধানকে চিঠি দেওয়া ছাড়াও ২ জানুয়ারি সরাসরি কারা অধিদপ্তরে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সংশ্লিষ্ট টিম।
তদন্ত কমিটি তাদের মতামতে জানিয়েছে, জরুরি ভিত্তিতে সরাসরি খাদ্যপণ্য সংগ্রহ বা কেনার ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবি হলো অন্যতম প্রতিষ্ঠান। পিপিআরের সংশ্লিষ্ট বিধিমালা অনুযায়ী টিসিবির মাধ্যমে উল্লেখিত খাদ্যপণ্য সরাসরি কেনাকাটা করাই ছিল কারা কর্তৃপক্ষের জন্য সর্বোত্তম পথ। কিন্তু তা করা হয়নি। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি প্রশ্ন উত্থাপন করলে কেন্দ্রীয় এবং জেলা কারাগারের জেল সুপাররা জানান, টিসিবি এবং কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে তারা মসুর ডালের দর সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু ঠিকাদার হানিফ এন্টারপ্রাইজের দরের সঙ্গে (৭৫ টাকা) মিল থাকায় ঠিকাদারের কাছ থেকে মসুর ডাল সংগ্রহ করেন। কিন্তু দামের মিল থাকা সত্ত্বেও তারা কেন টিসিবি কিংবা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে মসুর ডাল কেনেননি সে বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
তদন্ত প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য তথ্য : কক্সবাজার কারাগারের তথ্য পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলা হয়, স্থানীয় যেসব ঠিকাদার করোনা পরিস্থিতির দুর্দিনে আগের মূল্যে মসুর ডাল সরবরাহ করেছিলেন তাদের বাদ দিয়ে সুদূর ঢাকায় অবস্থানরত হানিফ এন্টারপ্রাইজকে কেন ডাল সরবরাহের অফার দেওয়া হলো সেটি বোধগম্য নয়। মূল্যায়ন কমিটির সদস্যরা এবং সর্বোপরি কারা অধিদপ্তরও বিতর্কিত প্রস্তাবটি অনুমোদন করে দিলেন। এসব প্রশ্নের সদুত্তর কেউই তদন্ত কমিটির কাছে দিতে পারেননি। অথচ এহেন প্রক্রিয়ায় ডাল কিনে সরকারের আর্থিক ক্ষতি করা হয়েছে। নরসিংদী, কুমিল্লা এবং কাশিমপুর কারাগারের ডাল কেনা প্রসঙ্গে বলা হয়, এসব কারাগারের তালিকাভুক্ত স্থানীয় ঠিকাদাররা সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের দাবি রাখলেও তাদের কাছ থেকে দর প্রস্তাব নেওয়া হয়নি।
ইজিপিতে সর্বনিম্ন দরদাতার সিদ্ধান্তটি সিপিটিইউ সিস্টেমে পেন্ডিং দেখানোর বিষয়টিও তদন্ত কমিটির কাছে সন্দেহজনক মনে হয়েছে। মূলত শুরু থেকেই এখানে একটি সিন্ডিকেট কাজ করেছে। যারা সিপিটিইউ সিস্টেমে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড গ্রহণের বিষয়টি পেন্ডিং রাখতে সক্ষম হয়। যাতে ১ম সর্বনিম্ন দরদাতা ঠিকাদাররা কারাগারে ডাল সরবরাহ করেনি বলে অজুহাত সৃষ্টি করা যায়। এ চক্রান্তে তারা সফল হয় এবং তাদের সরাসরি ডাল কেনার পথকে সুগম করে।
অভিযুক্ত ঠিকাদার হানিফ এন্টারপ্রাইজ ডাল কেনার এ প্রক্রিয়ায় যেসব কাগজপত্র দাখিল করেছে তার বেশিরভাগ জাল বা নকল। এমনকি যে ব্যাংক সার্টিফিকেট বা পারফরম্যান্স গ্যারান্টির কাগজ জমা দিয়েছে, তাও জালজালিয়াতির মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়েছে। আইএফআইসি ব্যাংকের ঢাকার মৌলভীবাজার শাখা থেকে একই স্মারকে একাধিক ব্যাংক সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে। যাতে কোনো তারিখ উল্লেখ নেই। শুধু প্রাপকের জায়গাটিতে ফটোকম্পোজের মাধ্যমে পরিবর্তন করে কোথাও সিনিয়র জেল সুপার বা কোথাও জেল সুপার লেখা হয়েছে। একই ভাষায় এবং একই বিষয়ের ওপর লিখিত অথচ এই ব্যাংক সার্টিফিকেট সব কারাগার এবং কারা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গ্রহণ করেছেন। অবাক বিষয় হলো, সংশ্লিষ্ট জেল কর্তৃপক্ষ এবং মূল্যায়ন কমিটির সদস্যরা নকল ব্যাংক সার্টিফিকেটসহ দাখিলকৃত নকল কাগজপত্রের সত্যতা যাচাই করে দেখার প্রয়োজনও মনে করেনি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, হানিফ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী নিজে একজন ভুসি বিক্রেতা। অথচ তাকে দেওয়া হয় মসুর ডাল সরবরাহের অফার লেটার। এছাড়া স্থানীয়ভাবে প্রতিটি কারাগারের জন্য তালিকাভুক্ত যোগ্য ঠিকাদার থাকা সত্ত্বেও ঢাকা থেকে শুধু হানিফ এন্টারপ্রাইজকেই মনোনীত করা হয়েছে। এখানে সব রহস্য লুকিয়ে আছে।
এদিকে এ বিষয়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের অনেকে দাবি করেন ডাল কেনায় কোনো অনিয়ম হয়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জেল সুপার বলেন, সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের কাছ থেকে ডাল কিনতে ওপর থেকে বাধ্য করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে কথা বললে চাকরি চলে যাবে। এছাড়া করোনা মহামারির কঠিন সময়ে জরুরি ভিত্তিতে এভাবে সরাসরি ডাল কেনা হয়।