যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির এমপি ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিক বলেছেন, তিনি তার খালার পক্ষে সাফাই গাইছেন না; বরং চান বাংলাদেশের জনগণ প্রয়োজনীয় ন্যায়বিচার পাক।
টিউলিপ আরও বলেন, “সত্য কথা বলতে, আমি এই ইউনুস-হাসিনা দ্বন্দ্বের বলির পাঁঠা মাত্র। বাংলাদেশে অবশ্যই কিছু মানুষ ভুল করেছে এবং তাদের শাস্তি হওয়া উচিত, কিন্তু আমি তাদের কেউ নই।”
ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের চিফ রিপোর্টার ড্যানিয়েল বফিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন টিউলিপ। রোববার (১০ আগস্ট) সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়।
তিনি জানান, এক সপ্তাহ আগে এক সাংবাদিকের মাধ্যমে জানতে পারেন, বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের অভিযোগ অনুযায়ী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগনি হিসেবে টিউলিপ তার মায়ের, ভাইয়ের ও বোনের জন্য ঢাকার পূর্বাচলে এক খণ্ড জমি প্রভাব খাটিয়ে নিশ্চিত করেছিলেন। টিউলিপ এই অভিযোগকে ‘সম্পূর্ণ হাস্যকর’ বলে মন্তব্য করেছেন। তার এবং আরও ২০ জনের বিরুদ্ধে বিচার শুরুর তারিখ নির্ধারিত হয়েছে ১১ আগস্ট। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে হাজির হবেন কি না, এখনও সিদ্ধান্ত নেননি।
টিউলিপ সিদ্দিক বলেন, তিনি ব্রিটিশ আইনজীবী হুগো কিথ কেসির পরামর্শ নিচ্ছেন। এখনো তিনি কোনো আনুষ্ঠানিক সমন পাননি। তিনি নিজেকে এক ‘কাফকায়েস্ক দুঃস্বপ্নে’ আটকা পড়া মনে করছেন, যেখানে তাকে বিদেশে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে অথচ এখনও জানেন না আসল অভিযোগগুলো কী।
‘কাফকায়েস্ক দুঃস্বপ্ন’ বলতে বোঝানো হয় এমন এক অবস্থা যা জটিল, অদ্ভুত ও অযৌক্তিক, সাধারণত নিপীড়ক আমলাতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত।
বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে প্রত্যর্পণ চুক্তি না থাকলেও দোষী সাব্যস্ত হলে বিষয়টি পুনরায় পরীক্ষার মুখোমুখি হতে পারে।
গত বছরের জুলাইয়ে লেবার পার্টির ক্ষমতায় আসার পর টিউলিপ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে ট্রেজারি বিভাগের অর্থনৈতিক সচিব এবং সিটি মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তিনি আর্থিক খাত পর্যালোচনায় সক্রিয় ছিলেন।
সেই সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছিল। ছাত্র নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসন পতিত হয়। হাজারো মানুষের মৃত্যুর পর তিনি এবং তার বোন শেখ রেহানা ভারতে পালিয়ে যান।
টিউলিপের দাবি, ২০২৪ সালের শেষ দিকে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও শেখ হাসিনার ‘রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী’ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর থেকেই বাংলাদেশের ‘কদর্য রাজনীতি’ তার জীবনে প্রভাব ফেলতে শুরু করে।
কিছু অননুমোদিত ওয়েবসাইটে খবর ছাপা হয় যে, তিনি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প থেকে ৫০০ কোটি ডলার আত্মসাৎ করেছেন।
২০১৩ সালের একটি ছবিতে দেখা যায়, মস্কোতে শেখ হাসিনা ও ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সিদ্দিক। তিনি ব্যাখ্যা দেন, তারা শুধুমাত্র বেড়াতে গিয়েছিলেন এবং শেষ দিনে আনুষ্ঠানিক চা পার্টিতে দুই মিনিটের জন্য পুতিনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
টিউলিপের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ হলো, ২০০৪ সালে লন্ডনের কিংস ক্রস এলাকায় তাকে বিনামূল্যে একটি ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছিল। ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার খালা শেখ হাসিনার দলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
তবে টিউলিপ দাবি করেন, ওই ব্যক্তি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় নন এবং তাকে ভোটও দেননি। তিনি আগের এক সাক্ষাৎকারে ভুলবশত বলেছিলেন, ফ্ল্যাটটি তার বাবা-মা কিনেছেন, যা তাঁর মা-বাবার ‘দুর্বল স্মৃতির’ কারণে হয়েছিল।
এক প্রশ্ন উঠেছিল, কেন তিনি নিজের বাড়ি থাকা সত্ত্বেও ক্রিকলউডে এক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ডেভেলপারের বাড়িতে থাকতেন। টিউলিপ বলেন, নিরাপত্তার কারণে তাকে হঠাৎ বাড়ি বদলাতে হয়েছিল এবং পরিচিত এক ব্যক্তির কাছ থেকে ওই বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের অভিযোগের পর তিনি নিজেই ব্রিটিশ মন্ত্রীদের নৈতিক মানদণ্ড বিষয়ে স্বাধীন উপদেষ্টা স্যার লরি ম্যাগনাসের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করেন। দুই সপ্তাহের গভীর তদন্তের পর ম্যাগনাস তাকে কোড লঙ্ঘনের অভিযোগ থেকে মুক্তি দেন। তবে ম্যাগনাস মন্তব্য করেন, পারিবারিক সম্পর্কের কারণে সৃষ্ট সুনামের ঝুঁকি সম্পর্কে আরও সচেতন হওয়া উচিত ছিল।
টিউলিপ বলেন, “আমি জন্মসূত্রে কার ভাগনি, সেটা আমার হাতে নেই।”
স্টারমারের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও বিভ্রান্তি এড়াতে তিনি পদত্যাগ করেন। স্টারমার তাকে ভবিষ্যতে ফেরার ইঙ্গিত দেন। তবে অভিযোগ থামেনি এবং বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ থেকেও স্পষ্ট কোনো তথ্য আসেনি।
সিদ্দিক জানান, যুক্তরাজ্যে সফরকালে তিনি মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা তা প্রত্যাখ্যান করেন।
এদিকে, যুক্তরাজ্যের অপরাধ দমন সংস্থা শেখ হাসিনা-সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তির প্রায় ৯ কোটি পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তি জব্দ করেছে, যার একটিতে তার মা বসবাস করতেন। টিউলিপ জানান, এ সম্পত্তির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।



