অপকৃত শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা এখনও সচিবালয়সহ প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও সংস্থায় আধিপত্য বিস্তার করছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর শীর্ষ পদগুলোতে সামান্য পরিবর্তনই হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাসিনার নিয়োগকৃত অধিকাংশ কর্মকর্তা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে অবশিষ্ট রয়েছেন। তারা গোষ্ঠীবদ্ধ এবং সময়ে সময়ে গোপন বৈঠক করেন যেন সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে অনেকেই সচিবালয়ে শেখ হাসিনার পক্ষে ‘আমলা বিদ্রোহ’ এবং নির্বাচন ভণ্ডুল করার আশঙ্কা করছেন।
১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে মোহিউদ্দিন খান আলমগীরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা ‘জনতার মঞ্চ’ নামে আন্দোলন পরিচালনা করেন এবং এক পর্যায়ে সচিবালয়ে ‘আমলা বিদ্রোহ’ সংঘটিত হয়। এই দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের সুবিধাভোগীদের মধ্যে এর পুনরাবৃত্তির সংকেত দেখা যাচ্ছে।
পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারহিনা আহমেদ ছাত্রলীগ করতেন। তার কিছুই হয়নি। স্বপদেই রয়েছেন। সাতক্ষীরা হত্যাযজ্ঞের নির্দেশদাতা হিসেবে চিহ্নিত সচিব নাজমুল আহসানকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব করা হয়েছে। অর্থ সচিব ড. খায়রুজ্জামান সালমান এফ রহমান এবং পলাতক গভর্নর রউফের লোক হিসেবে পরিচিত। ইআরডি সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকী ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসর ইসমত আরা সাদিকের পিএস ছিলেন। নাজমা মোবারক এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান ও পলাতক গভর্নর রউফ এবং পতিত সরকারের অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকার বন্ধু। তারাও আছেন বহালতবিয়তে এবং পদোন্নতি পাচ্ছেন।
হাসিনার দোসর হিসেবে চিহ্নিত অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সিরাজুন নূর চৌধুরী (৬৩৬২) ও ইআরডি অতিরিক্ত সচিব একেএম শাহাবউদ্দিনকে (৬৩৫৯) ইতোমধ্যে সচিব করা হয়েছে। তেমনি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির জন্য অন্যতম অভিযুক্ত মেজবাহ উল হকের স্ত্রী তসলিমা কানিজ নাহিদকেও (৬৩৪০) সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অথচ পদোন্নতি ও পদায়নের জন্য গঠিত কমিটি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট-পরবর্তীকালে পদোন্নতিপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিবদের সচিব পদে পদোন্নতি দিতে অনীহা দেখাচ্ছেন।
৫ আগস্টের পরের সরকারি আদেশ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জুলাই আন্দোলনের সমর্থকদের প্রতি অবহেলা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, যারা টুঙ্গিপাড়া বা ৩২ নম্বরে গিয়ে ফুল দিয়ে ছিলেন, তাদের পদায়ন ও পদোন্নতি করা হচ্ছে।
সচিবালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট ২০২৪-এর আগের সময়ে শেখ হাসিনার আমলে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বর্তমান সরকার সচিব পদে উন্নীত করেছে। তারা ফ্যাসিস্টদের সহযোগী ছিলেন এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিরোধিতা করেছেন। অন্যদিকে, ৫ আগস্টের পর অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত এবং দীর্ঘ ১৭ বছর বঞ্চিত ও নির্যাতিত কর্মকর্তাদের সচিব পদে পদোন্নতি বা পদায়ন করা হচ্ছে না। অভিজ্ঞতার অভাবকে অজুহাত দেখানো হচ্ছে। তাদের মধ্যে খুব সামান্য সংখ্যককে সচিব পদে পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে, যদিও তারা সচিবালয়ের স্বীকৃত পেশাদার কর্মকর্তা।
অবসরপ্রাপ্ত সচিব, অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি ও বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের সভাপতি এবিএম আবদুস সাত্তার শুক্রবার বিয়াম মিলনায়তনে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের আয়োজিত সেমিনারে বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধান সচিবের উপস্থিতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমার ব্যাচমেট এবং বন্ধু মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধান সচিব ও জনপ্রশাসন সচিব ফোন করলে ফোন ধরেন না। তারা ফ্যাসিস্ট আমলের অপকর্মের হোতা আমলাদের অপসারণে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। বিগত ১৭ বছরের বঞ্চিত ও নির্যাতিত কর্মকর্তাদের যথাযথ পদায়ন এবং পদোন্নতির উদ্যোগ নিচ্ছেন না। এটা দুঃখজনক।” তিনি আরও অভিযোগ করেন, তাঁর কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের আটজন উপদেষ্টার দুর্নীতির প্রমাণ রয়েছে। “এই উপদেষ্টাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ বা বদলি হয় না,” তিনি যোগ করেন।

