বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বিভীষিকাময় অধ্যায়গুলোর একটি হলো বিডিআর হত্যাকাণ্ড। সেদিন ৫৭ জন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন। বিডিআরের কিছু সদস্যের সঙ্গে যোগসাজশ করে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলে নূর তাপস ও অন্যান্য নেতারা এই হত্যাযজ্ঞের ষড়যন্ত্র ও প্রস্তুতি করেছিলেন। সরাসরি জড়িত থাকার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও কখনো তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি।
সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাক্ষ্য দেন। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার। জুলাই–আগস্ট মাসে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে শেখ হাসিনার মামলায় তিনি ৪৬তম সাক্ষী হিসেবে এই সাক্ষ্য দেন।
সকাল ১১টা ২০ মিনিটে মাহমুদুর রহমান সাক্ষীর আসনে দাঁড়ান। নিজেকে সাংবাদিক, লেখক ও ইতিহাসবিদ হিসেবে পরিচয় দিয়ে তিনি ট্রাইব্যুনালকে জানান, তিনি ফ্যাসিবাদী শাসনের উত্থান, বিস্তার ও পতনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী।
জবানবন্দিতে তিনি বলেন: “গত ১৭ বছর ধরে আমি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছি। এই ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছিল নিখুঁত পরিকল্পনার মাধ্যমে। সেই পরিকল্পনায় বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি একটি বিদেশি শক্তিও জড়িত ছিল। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর আত্মজীবনীমূলক বই The Coalition Years থেকে আমি উদ্ধৃত করতে চাই। সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, ২০০৮ সালে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় ঢাকার সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদের সঙ্গে দিল্লিতে তার কথোপকথনের বিবরণ। সেই আলোচনায় একটি সমঝোতা হয়—যদি শেখ হাসিনাকে নির্বাচন জিতিয়ে প্রধানমন্ত্রী বানানো হয়, তবে মইন ইউ আহমেদ চাকরির নিশ্চয়তা, আর্থিক সুবিধা এবং নিরাপদ প্রস্থান পাবেন।”
সেই বৈঠকটি হয়েছিল ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। নির্বাচন হয়েছিল ওই বছরের ডিসেম্বরে। অর্থাৎ ভোটের ১০ মাস আগে দিল্লিতেই ফল নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। এ প্রক্রিয়ায় সরাসরি ভূমিকা ছিল জেনারেল মইন এবং ডিজিএফআইয়ের। তখন ডিজিএফআইয়ে কর্মরত ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মামুন খালেদ, যিনি পরবর্তীতে প্রধান হয়েছিলেন। ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমে বিএনপিকে বিভক্ত করার চেষ্টাও হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন যে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা প্রয়োজন। সেনাবাহিনীর মনোবল অটুট থাকলে তারা কোনোভাবেই বিদেশি শক্তির ইঙ্গিতে পরিচালিত পুতুল সরকার মেনে নেবে না। তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্ষমতায় আসার মাত্র দুই মাসের মধ্যে শেখ হাসিনা বিডিআর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেন। এ পরিকল্পনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্য ও ধানমন্ডির তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগেই তাপস ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতারা বিডিআরের কিছু সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ তৈরি করেন। পরিকল্পনামতো ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক ৫৭ জন অফিসারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবং তাদের পরিবারের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, তাপসের জড়িত থাকার অকাট্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাকে কখনো বিচারের সম্মুখীন করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনার মনে সেনাবাহিনীর প্রতি গভীর বিদ্বেষ ছিল।
মাহমুদুর রহমান আরেকটি বইয়ের উল্লেখ করেন—The Jamdani Revolution। এটি লিখেছেন বাংলাদেশের সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার কৃষ্ণন শ্রীনিবাসন। বইটিতে তিনি ১৯৯৩ সালের একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। সে সময় বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা এবং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। বিদায়ী সাক্ষাতে শেখ হাসিনা ভারতীয় হাইকমিশনারকে অনুরোধ করেছিলেন যেন ভারত অস্বীকার করে যে শান্তিবাহিনী পাহাড়ে সহিংসতা চালাচ্ছে। বরং আন্তর্জাতিক মহলে যেন বলা হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীই গোষ্ঠী স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামে সহিংসতা চালাচ্ছে। এছাড়া ভারত যেন ঘোষণা দেয় যে তারা শান্তিবাহিনীকে কোনো প্রশিক্ষণ বা সহায়তা দিচ্ছে না। এমন রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্যে বিস্মিত হয়ে হাইকমিশনার জিজ্ঞেস করেছিলেন, আন্তর্জাতিক মহল কি এসব বিশ্বাস করবে? কিন্তু শেখ হাসিনা একই অনুরোধ পুনরায় করেন।
প্রকৃতপক্ষে তার সেনাবাহিনী-বিরোধী মনোভাব বাকশালের পতনের সময় থেকেই শুরু হয়। শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও সেনাবাহিনীর প্রতি অনীহা দেখিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাসকে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানের মতো এক দানব সেনাবাহিনী তিনি বাংলাদেশে চান না। তাই সেনাবাহিনীর বিকল্প হিসেবে তিনি রক্ষীবাহিনী গঠন করেছিলেন। এই পারিবারিক সেনা-বিরোধী মনোভাব থেকেই শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন সেনাবাহিনীর মেরুদণ্ড ও মনোবল ভেঙে দিতে। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি অনেকাংশে সফল হয়েছিলেন। সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে আনার পর, ফ্যাসিবাদী শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিচার বিভাগে মনোযোগ দেন।

