১৯৯৬ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ৩০ বছরের মেয়াদযুক্ত গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হতে যাচ্ছে। দুই পক্ষই চুক্তি নবায়নে সম্মত এবং সেই প্রক্রিয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) কর্মকর্তারা দিল্লিতে বৈঠকে বসবেন।
যৌথ নদী কমিশনের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বৈঠকে অংশগ্রহণ করতে ঢাকার পক্ষ থেকে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ আবুল হোসেনের নেতৃত্বে একটি কারিগরি দল নয়াদিল্লি সফর করবে। বৈঠকের মূল আলোচনা হবে গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তির নবায়ন।
বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলে দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান এবং এখনও সেখানে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশ-ভারতের রাজনৈতিক সম্পর্ক কিছুটা তলানিতে থাকলেও পানি ইস্যুতে দুই পক্ষ নিয়মিত আলোচনা চালাচ্ছে। চলতি বছরের মার্চে দিল্লিতে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রতি বছর দু’বার গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা হয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। তবে গঙ্গা ছাড়া অন্য কোনো নদীর পানি বণ্টনের চুক্তি হয়নি। তিস্তার পানির বণ্টন নিয়ে এখনো সমাধান হয়নি, প্রধান কারণ হলো কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসহযোগিতা।
১৯৯৬ সালে গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ভারতের প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়া ও শেখ হাসিনার মধ্যে। চুক্তির মেয়াদ ছিল ৩০ বছর এবং আগামী বছর তা শেষ হওয়ার কথা। ২০২৪ সালের জুনে দুই দেশ জানিয়েছিল যে চুক্তি নবায়নের কারিগরিগত আলোচনা শুরু হয়েছে।
ভারতীয় গণমাধ্যম প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই) আগস্টের ১ তারিখে জানিয়েছে, ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কীর্তি বর্ধন সিং সংসদে জানান যে, গঙ্গা চুক্তি নবায়নের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এখনও শুরু হয়নি। তবে নবায়নের আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারসহ সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের সঙ্গে গৃহস্থালি ও কল-কারখানায় পানি প্রয়োজনীয়তা নিয়ে মতামত নেওয়া হয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, মার্চে দিল্লিতে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে কিছু ইস্যুতে একমত হওয়া যায়নি, তাই কোনো দলিল (মিনিটস) সই হয়নি। গত বছরও নবায়নের আলোচনা শুরু হওয়ার ঘোষণা দিলেও ভারতীয় সংসদে প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে, দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এখনো শুরু হয়নি। আগামী বৈঠকে দিল্লি কী অবস্থান নেবে তা এখনই স্পষ্ট নয়।
যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ আবুল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, “এটি আমাদের রুটিন বৈঠক। চুক্তি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত আলোচনা হয়। আমরা অন্য কোনো এজেন্ডা নিয়ে কথা বলি না। মূল আলোচনা চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়েই।”
গত ডিসেম্বরে ঢাকায় বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ফরেন অফিস কনসালটেশন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে গঙ্গা চুক্তি নবায়ন ইস্যুতে দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিবরা আলাপ করেন। বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন বলেছিলেন যে আলোচনায় আন্তঃনদী বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৬-৭ মার্চ কলকাতায় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৬ মার্চ ফারাক্কায় গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি সম্পর্কিত যৌথ কমিটির ৮৬তম সভা এবং ৭ মার্চ কারিগরি বৈঠক হয়। গত বছর নভেম্বরে ফারাক্কায় ৮৫তম সভা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই বৈঠকে গঙ্গার পানি বণ্টনের বিস্তারিত আলোচনা হয়।
কারিগরি বৈঠকে দু’দেশের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত নদী বিষয়ক বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। ১৯৯৬ সালের চুক্তি বাস্তবায়নের পর থেকে প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশের চার সদস্যের দল ও ভারতের চার সদস্যের দলের উপস্থিতিতে প্রতিদিন চারবার গঙ্গার পানি মাপা হয় এবং চুক্তি অনুযায়ী ভাগ করা হয়। এরপর উচ্চপর্যায়ের কমিটি যাচাই করে যে চুক্তি ঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না।
কারিগরি দলের পর্যবেক্ষণে পানির ভাগাভাগি গাইডলাইন অনুযায়ী ঠিকভাবে হচ্ছে। তবে এবার গঙ্গার পানি প্রবাহ কম হওয়ায় বাংলাদেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং ভারতের কাছে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। মার্চে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে কিছু বিষয়ে একমত হওয়া যায়নি, তাই কোনো মিনিটস সই হয়নি। এটি অস্বাভাবিক নয়। অতীতেও বিভিন্ন সভায় এমন ঘটনা ঘটেছে। দুই পক্ষ পরবর্তীতে কূটনৈতিক মাধ্যমে মতৈক্যের ভিত্তিতে সই করার চেষ্টা করবে।

