নির্বাচন ঘিরে নানা ধরনের জরিপের ফলাফল সামনে আসছে। প্রায় সব দেশেই নির্বাচনের আগে জরিপ চালানো হয়, যাতে আগাম পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করা যায়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক সংগঠন নিজেদের উদ্যোগে এসব জরিপ পরিচালনা করে নির্বাচনী মাঠের চিত্র আঁকতে চায়। বিশ্লেষকেরা আবার এসব জরিপের ফলাফল ও নিজেদের ধারণা মিলিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেন।
অনেক সময় এসব জরিপ বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায়, আবার অনেক সময় একেবারেই মেলে না। অনেক জরিপই ভুল প্রমাণিত হয় এবং নির্বাচনে ভিন্ন ফলাফল বেরিয়ে আসে। ভোটের হিসাব–নিকাশ খুব সহজ কোনো কাজ নয়, তাই জরিপও বিভ্রান্তিকর হতে পারে।
যখন কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে জরিপ করা হয়, তখন তা আসল নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে মেলে না। তারপরও অনেক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থে এ ধরনের জরিপ করে থাকে।
গবেষণা প্রক্রিয়ার ভাষায় এগুলোকে বলা হয় “বায়াসড” বা “পার্পাসিভ সার্ভে।” যারা জরিপ পরিচালনা করে, তারা যে ফলাফল দেখতে চায় বা প্রত্যাশা করে, সেই অনুযায়ী জরিপের নকশা তৈরি হয়। জরিপে মাঠের প্রকৃত ছবি আসতে পারে, আবার তা ইচ্ছেমতোও বানানো যায়। বিষয়টি নির্ভর করে তথ্য সংগ্রহের ধরন ও নমুনা নির্বাচনের কাঠামোর ওপর।
উদাহরণস্বরূপ, জার্মানির বন শহরে ধূমপানের প্রবণতা নিয়ে জরিপ ধরুন। যদি বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন বা পানশালার ভেতরে জরিপ করা হয়, ফলাফল ধূমপানের পক্ষে আসবে। আবার পরিবেশবাদী সংগঠন বা বন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবাদী ছাত্রদের মধ্যে জরিপ চালালে ফলাফল ধূমপানের বিপক্ষে আসবে। প্রকৃত চিত্র পেতে হলে পুরো শহরজুড়ে জরিপ চালাতে হবে, কিন্তু সেটি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়সাপেক্ষ—এমন জরিপ সাধারণত নির্বাচন বা জনমতের গবেষণায় করা হয় না।
সম্প্রতি বাংলাদেশেও নির্বাচনকে ঘিরে এ ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জরিপ দেখা যাচ্ছে। উল্লেখযোগ্য হলো, এসব জরিপকে ভুল বলা কঠিন, কারণ কাগজে-কলমে গবেষণা নকশা, নমুনার আকার ও তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক মনে হয়। তবুও ফলাফল গিয়ে মিলে যায় একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর পক্ষে।
যেমন শেখ হাসিনার শাসনের শেষ দিকে জরিপে বলা হয়েছিল, তিনি বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আবার ক্ষমতায় আসবেন। কিন্তু বাস্তবে ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে ৫ শতাংশ মানুষও ভোট দিতে যায়নি। এমনকি আওয়ামী লীগের সমর্থকেরাও ভোটকেন্দ্রে যাননি। ফলে স্পষ্ট হয়, সেই জরিপগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল।
এখনও একই ধরনের জরিপ দেখা যাচ্ছে। শেখ হাসিনা পালানোর পর অক্টোবরে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এক জরিপ চালিয়ে জানায়, তখন নির্বাচন হলে মাত্র ১৬ শতাংশ মানুষ বিএনপিকে ভোট দেবে এবং ৩৮ শতাংশ কোনো দলকেই সমর্থন করছে না। অথচ বাস্তবে তখন বিএনপির জনসমর্থন তুঙ্গে ছিল।
তাহলে প্রশ্ন আসে, এ ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জরিপ কেন করা হয়? একটি কারণ জনমত প্রভাবিত করা। যদি ভোটাররা বিশ্বাস করে বিএনপির জনপ্রিয়তা কমে গেছে, তবে সমাজের একটি অংশ প্রভাবিত হবে। আরেকটি কারণ হতে পারে, জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে বিএনপিকে চাপের মধ্যে ফেলা।
শেখ হাসিনা পালানোর পর বিএনপি তখনও পুরোপুরি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে পারেনি। কিন্তু এবার জুলাইয়ের জরিপে বলা হচ্ছে বিএনপির সমর্থন নেমে এসেছে ১২ শতাংশে, আর ৪৯ শতাংশ মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়নি।
গত বছরের অক্টোবরে করা জরিপটি খুব আলোচিত হয়নি, কারণ তখনই আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারিয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু বিআইজিডির এই দুই জরিপ নিয়েই সন্দেহ আছে। সত্যি বলতে, বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে মানুষ বিরক্ত, কিন্তু তাতে সমর্থন নেমে ১২ শতাংশ হওয়া অবিশ্বাস্য।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি সর্বনিম্ন আসন পেলেও তাদের ভোট ছিল ৩২.৮ শতাংশ। স্বাভাবিকভাবে সেটি এখন বাড়ার কথা। না বাড়লেও ভয়ংকরভাবে কমার কথা নয়। দাবি করা হচ্ছে চাঁদাবাজি ও দখলের কারণে বিএনপির জনপ্রিয়তা ভেঙে পড়েছে—এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। স্থানীয় রাজনীতি বহুদিন ধরে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হলো রাজনীতির অর্থনীতি অনেকাংশে এ অনিয়মের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবং সমাজে একটি বড় অংশ এ থেকে সুবিধাভোগী।
ব্যবস্থার পরিবর্তন অবশ্যই দরকার, কিন্তু এজন্য বিএনপির সমর্থন একেবারে ধসে পড়বে—এমনটা যুক্তিযুক্ত নয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলের প্রতি অন্ধ আনুগত্য এখনো প্রবল।
অন্যদিকে আরেকটি জরিপে দাবি করা হয়েছে, ৩১.৫৬ শতাংশ মানুষ জামায়াতে ইসলামীকে সমর্থন করে। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?
এই জরিপটি ৮ মার্চ ২০২৫ প্রকাশিত হয়। ইনোভিশন কনসাল্টিং জরিপটি পরিচালনা করে, আর এতে সহায়তা দেয় বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যানালাইসিস অ্যান্ড ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক (ব্রেইন) এবং ভয়েস ফর রিফর্ম নামের একটি সংগঠন (নেত্র নিউজ, ৯ মার্চ)।
আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদ ও গণহত্যার দায় নিয়ে দেশ থেকে পালিয়েছে। বিএনপির জনপ্রিয়তাও দখল ও চাঁদাবাজির কারণে কমেছে। কিন্তু ৩১ শতাংশ মানুষ জামায়াতকে সমর্থন করছে—এটি বাস্তবসম্মত নয়।
জামায়াত একটি ক্যাডারভিত্তিক দল। তাদের নিজস্ব নিয়মকানুন আছে, তারা সমাজের ভেতর আরেকটি সমাজ গড়ে তুলেছে। তাদের সদস্যরা আজীবন সেই চক্রেই সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে হঠাৎ করে জনসমর্থনে বড় উত্থান-পতন ঘটে না।
আমার ধারণা, জামায়াত নিজেরাও ৩১.৫৬ শতাংশ সমর্থনকে বিশ্বাস করে না। তাদের যদি ১৫–২০ শতাংশ সমর্থন থাকে, তাহলেই তারা সংসদে বড় শক্তি হয়ে উঠবে এবং নিশ্চয়ই বিনা দ্বিধায় নির্বাচনে অংশ নেবে।
ইনোভিশন কনসাল্টিংয়ের জরিপে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থনের হিসাব একেবারেই আলাদা এসেছে বিআইজিডির জরিপের চেয়ে। বিআইজিডির জরিপে জামায়াতের সমর্থন ১১ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নেমেছে, কিন্তু ইনোভিশনের জরিপে বিএনপির সমর্থন ৪১.৭ শতাংশ, যেখানে বিআইজিডি বলেছিল সর্বোচ্চ ১৬ শতাংশ।
অন্যদিকে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর জরিপ বলছে, ৭১ শতাংশ মানুষ সংসদের উচ্চকক্ষের জন্য আনুপাতিক আসন বণ্টন (পিআর) সমর্থন করে। এটি অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে, কারণ বাংলাদেশে এখনো কোনো উচ্চকক্ষ নেই এবং বিএনপি এ ব্যবস্থার বিরোধী। তাহলে এই ৭১ শতাংশ কোথা থেকে এলো?
সুজনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার ঐকমত্য কমিশনের সদস্য, আর এই কমিশন নিজেরাই পিআর ব্যবস্থার পক্ষে। জরিপের উত্তরদাতারাও কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে হুবহু একমত, যা এনসিপি ও জামায়াতের অবস্থানের সঙ্গে মিলে যায়। জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের পর্যন্ত এই জরিপকে সমর্থন জানিয়েছেন।
এতে স্পষ্ট যে জরিপের ফলাফল এনসিপি ও জামায়াতের বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে।
পদ্ধতিগত দিক থেকে এগুলোকে পুরোপুরি ভুল বলা যাবে না, কারণ এখানে গবেষণার বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। তবে মনে হচ্ছে এসব জরিপ হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে—নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে—অথবা গবেষণায় কোনো অদেখা ত্রুটি থেকে গেছে।
এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জরিপগুলো মনে করিয়ে দেয় ২০০১ সালের নির্বাচন-পূর্ব জরিপগুলোর কথা। তখন প্রায় সব পত্রিকাই বলেছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরবে, কেউ কেউ ১৭০ থেকে ২২০ আসন পাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিল। একমাত্র প্রথম আলো বলেছিল বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল বিএনপি বিপুল আসন জিতল, আর আওয়ামী লীগ পেল মাত্র ৫৭টি আসন। আবার মনে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন, যেখানে জরিপে হিলারি ক্লিনটন এগিয়ে ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতেছিলেন।
তাহলে কেন এ ধরনের জরিপ করা হয়? একটি কারণ জনমতকে প্রভাবিত করা—যাতে মানুষ ভাবে বিএনপির জনপ্রিয়তা কমছে এবং সেই প্রভাব ভোটারদের মনস্তত্ত্বে পড়ে। আরেকটি কারণ হতে পারে বিএনপিকে চাপ দিয়ে কিছু আদায় করে নেওয়া।
আমরা নিশ্চিত জানি না কেন এসব জরিপ করা হচ্ছে, তবে অনুমান করা যায়, এগুলো বিভ্রান্তি তৈরি করছে।
ভোটের মাঠে এসব জরিপ বিএনপির জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিএনপিকে কোণঠাসা করার চেষ্টা চলছে, এবং এই জরিপগুলো সম্ভবত সেই পরিকল্পনার অংশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চলছে যে বিএনপি সবকিছু দখল করছে, আর জরিপে দেখানো হচ্ছে এজন্যই তাদের জনপ্রিয়তা কমছে।
ড. মারুফ মল্লিক
রাজনৈতিক বিশ্লেষক



