ছাত্র আন্দোলনের ব্যাপক উত্তালতার মধ্যে গত বছর ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। তার দেশত্যাগের পর আওয়ামী লীগের বহু শীর্ষ নেতা, কর্মী এবং ঘনিষ্ঠ আমলারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। পরবর্তীতে তাদের অনেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের অবস্থান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা গুঞ্জন চলছিল। সেই গুঞ্জনের অবসান ঘটে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার দিকে, যখন রাজধানীর ধানমন্ডির নিজ বাসা থেকে তাঁকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ডিবির যুগ্ম কমিশনার মো. নাসিরুল ইসলাম।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর খায়রুল হক আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে গোপনে আত্মগোপনে চলে যান। তার বিচারিক কার্যক্রম ও ভূমিকাকে ঘিরে বহু বিতর্ক রয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করা ও গণতন্ত্রকে দুর্বল করার পেছনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে বহুজন মনে করেন। বিশেষ করে, বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের বাসভবন থেকে উচ্ছেদের মামলায় তার সরাসরি ভূমিকা ছিল।
বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন ও সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সঙ্গে খায়রুল হক আপিল বিভাগের বেঞ্চে ছিলেন, যারা কোন পূর্ণাঙ্গ শুনানি না করেই একতরফাভাবে খালেদা জিয়ার উচ্ছেদের পক্ষে রায় দেন। এই সিদ্ধান্ত দেশের রাজনৈতিক মহলে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে, কারণ আবেদনকারীকে উপযুক্ত বিচার পাওয়ার সুযোগই দেওয়া হয়নি।
তার একাধিক রায় রাজনীতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট ও আওয়ামী লীগপন্থী বলে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। বিচার বিভাগের ভেতরেও তার নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন ছিল, কারণ অন্য সিনিয়র বিচারপতিদের উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা সরকার তার বিচারপতি হিসেবে পদোন্নতি নিশ্চিত করেছিল। তিনি প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় সরকারি ত্রাণ তহবিল থেকে নিজের চিকিৎসার জন্য অর্থ গ্রহণ করায় জনরোষের মুখেও পড়েন।
সবচেয়ে বিতর্কিত ছিল তার প্রধান বিচারপতি হিসেবে দেওয়া একটি রায়, যেখানে ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। এই রায়ই শেখ হাসিনার জন্য একতরফা নির্বাচনের পথ সুগম করে দেয় এবং দেশের রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়। রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি ও সংক্ষিপ্ত আদেশের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকায় রায়টি ‘কেন্দ্র থেকে প্রভাবিত’ বলেও সমালোচিত হয়েছে।
এছাড়াও, তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিচারিক সিদ্ধান্ত দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। একটি আলোচিত রায়ে তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক নন বলে মন্তব্য করেন, যা একটি রাজনৈতিক পক্ষকে খুশি করলেও অপর পক্ষের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি করে। অবসর গ্রহণের প্রায় দুই বছর পর তিনি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ায় তার রাজনৈতিক পক্ষপাত নিয়ে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়।
অনেকের মতে, খায়রুল হকের বিচার বিভাগীয় ক্যারিয়ার শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা রেখেছে।

