ঢাকা মেডিকেল কলেজের মিটফোর্ড হাসপাতালে ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে মো. সোহাগ হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। বিএনপি মনে করছে, এই ঘটনাকে ঘিরে জামায়াতে ইসলামী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ‘রাজনৈতিক রূপ’ দিয়েছে এবং তা মূলত বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতেই পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। বিএনপির অভিযোগ, এই প্রক্রিয়ায় জামায়াত নানা মিথ্যাচার ও অপপ্রচারে জড়িয়ে পড়েছে এবং দীর্ঘদিনের মিত্র হয়েও ‘দলীয় সৌজন্যবোধ’ উপেক্ষা করছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রয়োজন হলেও জামায়াত-সহ কয়েকটি ইসলামী দল রাজনৈতিক বিভেদ সৃষ্টি করছে। তারা জানান, জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনপূর্ব কোনো জোট গঠনের পরিকল্পনা নেই, তবে ফ্যাসিবাদবিরোধী বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে পুরোনো মিত্রের কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করে বিএনপি।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, জামায়াত মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে। তিনি জানান, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যের মাধ্যমে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠলেও জামায়াত এখন সেই ঐক্যকে ভাঙার পাঁয়তারা করছে, যা কার্যত ফ্যাসিবাদের প্রত্যাবর্তনের পথ খুলে দেবে।
বিএনপি নেতারা দাবি করেন, নিহত লাল চাঁদ যুবদলের কর্মী এবং তার হত্যাকাণ্ড ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব থেকেই সংঘটিত হয়েছে। চাঁদাবাজির কোনো প্রমাণ না থাকলেও বিএনপি সংগঠনের পাঁচজনকে বহিষ্কার করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। তা সত্ত্বেও জামায়াতের পক্ষ থেকে ঘটনাটিকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া, এমনকি তারেক রহমানকে টার্গেট করে ষড়যন্ত্রমূলক বক্তব্য ও প্রচারণা চালানো হয়েছে—যা দলের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, জামায়াত অতীতে কখনোই রাজনৈতিকভাবে স্থির ছিল না। তারা সময় ও পরিস্থিতি বুঝে অবস্থান বদল করেছে। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, এক সময় জামায়াত ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে, পরে জাতীয় পার্টির, আবার বিএনপির বিরুদ্ধে, কখনও বিএনপির পক্ষে—এই পরিবর্তনশীল অবস্থান তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অভ্যাস। তার মতে, মিটফোর্ড ইস্যুতে তাদের বর্তমান অবস্থান সেই নীতিহীন ধারাবাহিকতারই আরেকটি উদাহরণ।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা মির্জা আব্বাস এক বক্তব্যে জামায়াতের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করে বলেন, তারা রাজনৈতিক সুবিধার জন্য কখনও আওয়ামী লীগ, কখনও এরশাদ, আবার কখনও বিএনপির ঘাড়ে ভর করে চলেছে। এখন বিএনপিকে শেষ করে রাজত্ব করতে চায় তারা। তিনি বলেন, তারেক রহমানের জনপ্রিয়তাই তাদের সহ্য হচ্ছে না।
এদিকে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী মন্তব্য করেছেন, জামায়াতসহ কিছু ইসলামী দল জিয়াউর রহমানের সুযোগে রাজনীতিতে এসেছে, অথচ এখন তারেক রহমানকে লক্ষ্য করে কুৎসা রটাচ্ছে। তিনি সরাসরি বলেন, অপপ্রচারে নামলে এর পরিণতি জামায়াতকে ভোগ করতে হবে।
জামায়াতের পক্ষ থেকেও পাল্টা প্রতিক্রিয়া এসেছে। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, রাজনীতিতে বিভক্তির এই পরিস্থিতিতে পরস্পরকে দোষারোপ করে কোনো উপকার নেই। তিনি স্বীকার করেন, তারেক রহমানকে লক্ষ্য করে অশালীন স্লোগান দেওয়া অনুচিত, তবে দাবি করেন, এসব স্লোগান জামায়াত-শিবিরের পক্ষ থেকে আসেনি।
পরওয়ার আরও বলেন, মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডে জামায়াত কারও নাম নেয়নি, বরং বিএনপি নিজেই অভিযুক্তদের বহিষ্কার করেছে। এতে প্রমাণ হয়, অপরাধীরা তাদের দলেরই ছিল। তিনি বিএনপিকে আহ্বান জানান প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে সরে এসে রাজনৈতিক সৌজন্য বজায় রাখতে।
বিএনপির অসন্তুষ্টির আরেকটি উৎস ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। চরমোনাই পীর সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীমের ভূমিকা নিয়েও ক্ষুব্ধ দলটি। মির্জা আব্বাস এই দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, তারা বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে, অথচ অতীতে আওয়ামী লীগকে মেনে নিয়েছে। ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনায়ও চরমোনাই পীরের নীরবতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
সবমিলিয়ে মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে বিএনপি ও জামায়াতের বহু বছরের রাজনৈতিক সম্পর্ক এখন স্পষ্ট সংকটে পড়েছে। ঐক্য নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে, যার প্রভাব আগামী নির্বাচনের রাজনীতিতেও পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

