সোহাগকে বাঁ*চাতে কেন এগিয়ে আসেননি বাহিনীর সদস্যরা, জানালেন আনসারপ্রধান

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের (মিটফোর্ড) ৩ নম্বর গেটের সামনে নির্মমভাবে খুন হন ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে মো. সোহাগ (৩৯)। চাঁদাবাজি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে সন্ত্রাসীদের হাতে প্রকাশ্য দিবালোকে তাকে হত্যা করা হয়। অথচ, ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে অবস্থান করছিল একটি আনসার ক্যাম্প। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি তাকে রক্ষা করতে। এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ এবং সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা।

গত ৯ জুলাই বিকেলে ঘটেছে মর্মান্তিক এ হত্যাকাণ্ড। সোহাগকে সন্ত্রাসীরা কংক্রিটের টুকরো ও ভারী বস্তু দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। হত্যার সময় অনেক পথচারী উপস্থিত থাকলেও কেউ বাধা দেয়নি, বরং অনেকে মোবাইল ফোনে ভিডিও করছিলেন। এসব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে নিন্দার ঝড় ওঠে।

ঘটনার সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো, মাত্র ১০০ গজ দূরেই একটি আনসার ক্যাম্প থাকা সত্ত্বেও কেউ ঘটনাস্থলে আসেনি সোহাগকে রক্ষা করতে। এই প্রশ্ন ঘিরেই উঠেছে নানামুখী বিতর্ক।

রোববার (১৩ জুলাই) রংপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, “ঘটনাস্থল থেকে ১০০ গজের মধ্যে আনসার ক্যাম্প ছিল। সদস্যদের কাছে অস্ত্র ছিল। কিন্তু কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। এটা সরকারের অব্যবস্থাপনার বড় প্রমাণ। সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।”

বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাও (১২ জুলাই) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক আলোচনায় বলেন, “এই ঘটনায় সরকার ও পুলিশের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, ভিডিও না এলে সরকার নীরব থাকত কেন? আনসার ক্যাম্পে থাকা সদস্যরা কী করছিলেন? এসব প্রশ্নের উত্তর সরকারকেই দিতে হবে।”

আলোচনার মুখে আনসার বাহিনীর মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল আবদুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “ঘটনার সময় ৩ নম্বর গেটে আনসার সদস্যের কোনো উপস্থিতি ছিল না। রোস্টার অনুযায়ী সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত একজন সদস্য দায়িত্বে ছিলেন। বিকেলে সেখানে আর কেউ ছিল না।”

তিনি দাবি করেন, “হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের জানায়নি যে, বিকেলবেলায়ও ওই গেটে আনসার সদস্য প্রয়োজন। দায়িত্ব নির্ধারণ করে হাসপাতালের পরিচালক ও প্রশাসন। তারা যদি নির্দেশনা না দেন, তাহলে সদস্যরা স্বপ্রণোদিতভাবে পদক্ষেপ নিতে পারে না।”

আনসার ডিজি আরও বলেন, “যখন ঘটনা ঘটে, তখন কেউ আনসার ক্যাম্পে গিয়ে খবর দেয়নি। এমনকি আমাদের প্লাটুন কমান্ডারকে জানানো হয়নি। তিনি যখন খবর পান, ততক্ষণে ঘটনাস্থলে সোহাগের বুকের ওপরে আক্রমণ চলছিল। এরপর তিনি এসে দ্রুত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানান এবং সোহাগকে গেটের ভেতরে নিয়ে যান।”

তিনি বলেন, “সিসিটিভি না থাকায় ক্যাম্প থেকে কিছু বোঝাও সম্ভব হয়নি। আমরা অনেকবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নিরাপত্তা ইস্যুতে সিসিটিভি লাগানোর পরামর্শ দিয়েছি। এমনকি দায়িত্ব পালনে সমস্যার কারণে কোনো কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আমরা আনসার প্রত্যাহার করি। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেটা পারি না।”

আনসার মহাপরিচালক বলেন, “এ ঘটনায় আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হচ্ছে তা অপ্রাসঙ্গিক ও মনগড়া। আমাদের ৬১ লাখ সদস্য এই হত্যাকাণ্ডে গভীরভাবে শোকাহত। তবে এ ঘটনাকে পুঁজি করে আনসার সদস্যদের পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা অনাকাঙ্ক্ষিত।”

তিনি আরও বলেন, “হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের স্পষ্ট নির্দেশ ছাড়া আমাদের সদস্যদের রোস্টারভুক্ত এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ নেই।”

সোহাগ হত্যার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। মানুষ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। অনেকেই বলছেন, এমন জনবহুল এলাকায় এভাবে দিনের আলোয় কাউকে খুন করে লাশের ওপর নাচা যায়—এটা বিশ্বাস করাও কঠিন। পাশে আনসার ক্যাম্প থাকলেও কেউ প্রতিক্রিয়া না দেখানোয় মানুষ শঙ্কিত ও ক্ষুব্ধ।

এই ঘটনা আবারও প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতা, নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং সরকারি হাসপাতালগুলোর নিরাপত্তা কাঠামোর ভঙ্গুর চিত্র সামনে নিয়ে এসেছে। সরকারের পক্ষে ব্যাখ্যা আসলেও তা জনমনে সংশয় কাটাতে পারছে না।

Scroll to Top