যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক এড়াতে ওয়াশিংটনে একের পর এক বৈঠকে ব্যস্ত সময় পার করছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিরা। শেষ মুহূর্তে সর্বাত্মক চেষ্টার মধ্যেও শুল্ক চুক্তি নিয়ে আশার আলো ক্রমেই ম্লান হয়ে আসছে বলে দাবি করছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।
যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে ইতোমধ্যে তিন লাখ টন গম কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে টনপ্রতি ২০-২৫ ডলার বেশি দিয়ে এই গম কেনা হচ্ছে, শুধুমাত্র ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক মসৃণ রাখতে।
সূত্রগুলো জানায়, মার্কিন প্রশাসনের মন জয় করতে লোকসান সত্ত্বেও আমদানি বাণিজ্য বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ। এর অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে নতুন বোয়িং উড়োজাহাজ আমদানির নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাড়ানো হচ্ছে তুলা আমদানিও। এমনকি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা বহু পণ্যের উপর শূন্য শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ আমদানি করেছে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য; রপ্তানি ছিল ৮৩৬ কোটি ডলার। অর্থাৎ বাণিজ্য ভারসাম্য যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূলে নয়, যা পাল্টা শুল্কের একটি অন্যতম কারণ।
গত ৩ এপ্রিল হঠাৎ ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশি পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ৩৭% শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়, যা ৯ এপ্রিল কার্যকরের কথা ছিল। তবে তখনই তিন মাসের জন্য সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়, যার মেয়াদ শেষ হচ্ছে ৯ জুলাই (বাংলাদেশ সময় ১০ জুলাই)।
এই তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ মার্কিন পক্ষের সঙ্গে শুল্ক চুক্তি নিয়ে একাধিক দফায় আলোচনায় বসেছে। ওয়াশিংটনে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, ঢাকার বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমানসহ দূতাবাসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। আলোচনার মূল লক্ষ্য—যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক আরোপ যেন শিথিল বা স্থগিত থাকে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানিয়েছেন, “প্রস্তাবিত চুক্তিতে অনেক কঠিন শর্ত রয়েছে। বাংলাদেশ তার সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু শর্ত মানতে আগ্রহী, তবে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেলে চুক্তি চূড়ান্ত হতে পারে।”
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি রপ্তানির গড় শুল্ক হার ১৫ শতাংশ। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষিত নতুন শুল্ক হার কার্যকর হলে তা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৫২ শতাংশে। এ কারণে একে রপ্তানি খাতের জন্য ‘চরম ক্ষতির শঙ্কা’ হিসেবে দেখছে ঢাকার নীতিনির্ধারকরা।
এই অবস্থায়, এপ্রিলেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি পাঠান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি শুল্ক কমাতে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত উদ্যোগ তুলে ধরেন। পাশাপাশি ইউএসটিআর-এর কাছে পাঠানো আলাদা চিঠিতে শেখ বশিরউদ্দীন জানান, বাংলাদেশ গঠনমূলক সংলাপে আগ্রহী এবং রপ্তানিবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বিশ্বজুড়ে বেশ কিছু দেশ, যেমন ভারত, জাপান, ভিয়েতনাম ও ইইউভুক্ত দেশগুলো একই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষি চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ইন্দোনেশিয়া ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে তারা আর আলোচনায় বসবে না।
সম্প্রতি, বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঠানো এক চিঠিতে ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা পণ্যের উপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হলো। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন যে এই নতুন শুল্ক হার চলতি বছরের ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে। এতে বলা হয়েছে যে দীর্ঘমেয়াদী বাণিজ্য ঘাটতি, শুল্ক বাধা এবং বাংলাদেশি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ক্ষেত্রে নীতিগত বাধার কারণে এই পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে।
চিঠিতে ট্রাম্প লিখেছেন, “বাংলাদেশের সাথে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি দীর্ঘদিনের। এটি কেবল মার্কিন অর্থনীতির জন্যই হুমকি নয়, জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকি। অতএব, আমরা মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের উপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছি। তবে, এটি এখনও বাংলাদেশের প্রকৃত পরিস্থিতির তুলনায় অনেক কম। আপনারা চাইলে মার্কিন মাটিতেই পণ্য উৎপাদন করতে পারেন, সেখানে কোনো শুল্ক থাকবে না।”
তিনি আরও বলেন যে যদিও বাংলাদেশকে তার পূর্বের অনুরোধে কিছু সময় দেওয়া হয়েছিল, এবার শুল্ক আরোপ অনিবার্য। তবে ট্রাম্প চিঠিতে আরও উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশ যদি মার্কিন পণ্যের উপর প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপের চেষ্টা করে, তাহলে ইতিমধ্যে আরোপিত ৩৫ শতাংশের সাথে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হবে।
ট্রাম্প ড. ইউনূসকে লিখেছিলেন, “আপনি যদি মার্কিন পণ্যের উপর শুল্ক বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করেন, তাহলে আপনি যে হার বাড়াতে চান তা আমাদের নির্ধারিত ৩৫ শতাংশ হারের সাথে যোগ করা হবে। অতএব, বাণিজ্য সহযোগিতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য আমি আপনাকে মার্কিন বাজার ব্যবস্থার প্রতি সদয় মনোভাব রাখার জন্য অনুরোধ করছি।”
চিঠিতে ট্রাম্প আরও বলেন— “যদি বাংলাদেশ তাদের শুল্ক ও অ-শুল্ক নীতিতে সংস্কার আনে এবং মার্কিন পণ্যের বাজারে প্রবেশ সহজ করে, তাহলে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে। নতুন শুল্ক হার ঊর্ধ্বমুখী বা নিম্নমুখী—তা নির্ভর করবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ওপর।”
চিঠির একাংশে ট্রাম্প বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র আপনার দেশের সাথে কাজ চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক। তবে এটি আরও সুষম এবং ন্যায্য বাণিজ্য নীতির উপর ভিত্তি করে হতে হবে।”
এর আগে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে, ড. ইউনূস ট্রাম্প প্রশাসনকে শুল্ক আরোপের আগে সময় চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন। সেই সময়, হোয়াইট হাউস তাকে তিন মাস সময় দিয়েছিল।

