আ.লীগের নজিরবিহীন লুটপাট, ঋণের বোঝা ইউনূস সরকারের কাঁধে

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যান। দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যাংক খাতে ঋণের নামে নজিরবিহীন লুটপাট হয়েছে। আত্মসাত করা অর্থ একদিকে যেমন বিদেশে পাচার করা হয়েছে, তেমনি দেশেও দুর্নীতির মাধ্যমে দখল করে রাখা হয়েছে। ফলে এসব অর্থ আর ব্যাংকে ফিরে আসছে না, যার কারণে ব্যাংক খাতে চরম তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো আমানতের উপর সুদের হার বাড়াতে বাধ্য হয়েছে।

এছাড়া, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণের কারণে ঋণের উপর সুদের হারও বেড়েছে। সুদের হার বৃদ্ধি ও তারল্য সংকটের কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের জোগান হ্রাস পেয়েছে। একই সঙ্গে, ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার যেসব উপকরণ রয়েছে, সেগুলোর উপরও সুদের হার বেড়ে গেছে তারল্য সংকটের কারণে। ফলে সরকারও এখন উচ্চ সুদের হারে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে, যার ফলে ঋণ গ্রহণের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ, ব্যাংক লুটপাটের বোঝা এখন সরকারের কাঁধেও এসে পড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন ইসলামী ব্যাংকসহ সাতটি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক এবং সরকারি মালিকানাধীন জনতা ব্যাংক যখন তারল্য সংকটে পড়ে, তখন থেকেই সুদের হার বাড়তে শুরু করে। এই নেতিবাচক প্রভাব শুরুতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে দেখা গেলেও এখন তা সরকারি খাতেও ছড়িয়ে পড়েছে। গত প্রায় দুই বছরে, সরকার যেসব উপকরণ ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে, সেগুলোর উপর সুদের হার ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে সুদের হার প্রায় দ্বিগুণ বা শতভাগ বেড়েছে।

সরকার তিন ধরনের ট্রেজারি বিল এবং পাঁচ ধরনের ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ গ্রহণ করে। এছাড়াও শরিয়াভিত্তিক আরও কয়েকটি বন্ড রয়েছে। সরকার এগুলো নিয়মিত নিলামের মাধ্যমে ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিক্রি করে ঋণ নেয়। তবে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট থাকায় এখন অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এসব বিল ও বন্ড কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আগে ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি বন্ডে বিনিয়োগে আগ্রহী ছিল, এখন তারা স্বল্পমেয়াদি বিলের দিকে ঝুঁকছে। তারপরও সরকারের চাহিদা অনুযায়ী নিলামে অংশগ্রহণকারী অর্থের পরিমাণ কম থাকছে, যার ফলে সুদের হার বাড়ছে।

২০২৩ সালের জুনে ৩ মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদের হার ছিল ৬.৮০ শতাংশ। ৬ এপ্রিল পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১.২৪ শতাংশে। ৬ মাস মেয়াদি বিলের সুদের হার একই বছরের জুনে ছিল ৭.০৭ শতাংশ, যা ৬ এপ্রিল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১.৪৫ শতাংশে। ১ বছরের ট্রেজারি বিলের সুদের হার ওই সময়ে ছিল ৭.৯০ শতাংশ, যা বেড়ে হয়েছে ১১.৭৫ শতাংশ। এত উচ্চ সুদের হারে সরকার ওই দিন ৯ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়।

২ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদের হার ২০২৩ সালের জুনে ছিল ৮.০৯ শতাংশ, যা এখন বেড়ে হয়েছে ১২.১৮ শতাংশ। ৫ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদের হার জুনে ছিল ৮.৭১ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ১০.৩৯ শতাংশ, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১.৫০ শতাংশে।

১০ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদের হার ২০২৪ সালের জুনে ছিল ১২.৫৯ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে তা কমে হয়েছিল ১০.২৩ শতাংশ, যা এখন আবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২.০৫ শতাংশে। ১৫ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদের হার গত বছরের জুনে ছিল ১২.৭০ শতাংশ, যা ফেব্রুয়ারিতে কমে দাঁড়িয়েছিল ১০.৪৯ শতাংশে, এখন তা বেড়ে ১২.২৮ শতাংশে পৌঁছেছে। ২০ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদের হার একই সময়ে ১২.৭৯ শতাংশ থেকে ফেব্রুয়ারিতে কমে হয়েছিল ১১.১৮ শতাংশ, এখন তা বেড়ে ১২.৫৪ শতাংশে পৌঁছেছে।

সূত্র জানায়, তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো এখন সরকারের ঋণের চাহিদা পূরণে অক্ষম। যার ফলে সুদের হার বেড়েই চলেছে।

৯ এপ্রিল ৬ মাস মেয়াদি বাংলাদেশ সরকার ইসলামী ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের মুনাফার হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে সর্বনিম্ন ৯ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশে। ৩ মাস মেয়াদি একই বন্ডের মুনাফার হার দাঁড়িয়েছে সর্বনিম্ন ৮ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৯.৫ শতাংশে। ওই দিন সরকার ১ হাজার ২২৫ কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ করেছে। তারল্য সংকটের কারণে সরকার এখন ব্যাংক থেকে কম ঋণ নিচ্ছে। পরিবর্তে সরকার এখন নন-ব্যাংক খাত থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই খাত থেকে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার ঋণ গ্রহণ করা হয়েছে। নন-ব্যাংক খাতের ঋণের সুদের হার আরও বেশি, যার ফলে সরকারের ঋণগ্রহণ ব্যয় বেড়ে গেছে। যার কারণে সুদের খাতে সরকারকে অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হচ্ছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারির মধ্যে সরকার ব্যাংক খাত থেকে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেছে, যা ব্যবহার করা হয়েছে আগের সরকারের সময়ে নেওয়া ঋণ পরিশোধে। তবে ওই সময় ছাপানো টাকার ঋণের স্থিতি ছিল বেশি। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯৭ হাজার কোটি টাকায়। আলোচ্য সময়ে সরকার ৫৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ছাপানো টাকার ঋণ পরিশোধ করেছে।

Scroll to Top