ড. ইউনূস ও তাবিথ আউয়ালকে ফাঁসাতে ফাঁদ পাতে মোহাম্মদ আলী মিয়া

নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে (বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান) ফাঁসাতে অর্থ পাচারের মিথ্যা মামলার ফাঁদ পেতেছিলেন সিআইডির তৎকালীন প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া। তবে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। একই সময়ে, প্রাক্তন সিআইডি প্রধান বিএনপি নেতা তাবিথ আউয়াল এবং তার দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তাকে চার্জশিট দাখিল করতে বাধ্য করেন।

প্রাক্তন সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী এভাবে মামলা বাণিজ্য করেই শত শত কোটি টাকা কামিয়েছেন
সিন্ডিকেট গড়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, আইনবহির্ভূত কার্যক্রম, স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) নিজের তালুকে পরিণত করেছিলেন সংস্থাটির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া। পুলিশের এই অতিরিক্ত আইজিপি সম্প্রতি বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন সিআইডির সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা, এতদিন প্রভাব খাটিয়ে যাদের ক্ষমতা খর্ব করে রেখেছিলেন তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিআইডির একাধিক বর্তমান ও প্রাক্তন কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বর্তমান প্রধান ড. মোহাম্মদ আলী ২০২৩ সালের গোড়ার দিকে মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিছু কর্মকর্তা ড. ইউনূসকে হয়রানি করার আপত্তি জানালে, মোহাম্মদ আলী তাদের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ সম্পর্কে অবহিত করেন এবং সিআইডির মানি লন্ডারিং শাখায় ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালানোর চিঠি ইস্যু করেন। গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৭ আগস্ট মোহাম্মদ আলী সিআইডি কার্যালয়ে এসে ড. ইউনূসের বিষয়ে অনুসন্ধান সংক্রান্ত সব কাগজপত্র নিয়ে যান বলে জানান ওই কর্মকর্তারা।

অনৈতিক নির্দেশ না শোনার জন্য কয়েকজনকে বদলি করা হয়

সিআইডির একজন পুলিশ সুপার অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পান। নতুন করে পদায়ন না হওয়ায় তিনি এসএসপি (বিশেষ পুলিশ সুপার) হিসেবে সাইবারের একটি শাখার দায়িত্বে ছিলেন। ওই কর্মকর্তা মামলা ও তদন্তের বিষয়ে মোহাম্মদ আলীর অনৈতিক নির্দেশনা না মানায় তাকে সেখান থেকে সরিয়ে অন্য জায়গায় পদায়ন করে রাখেন। আর তিনি এ কাজ করেন তার ক্যাশিয়ারখ্যাত পুলিশ সুপার ইমরান ভূইয়াসহ দুজন পুলিশ সুপারের পরামর্শে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি মামলায় প্রাথমিক তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন বিসিএস ২৪ ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা রায়হানুল ইসলাম, যাকে পদোন্নতি দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছিল। মোহাম্মদ আলীর অনুরোধে চার্জশিটে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নাম বাদ দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় তাকে অপসারণ করা হয়েছিল। তবে, প্রাক্তন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রায়হানুল ইসলাম সেই গুরুত্বপূর্ণ মামলায় তদন্তকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। দীর্ঘ তদন্তে তিনি জানতে পেরেছিলেন যে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় কার কী ভূমিকা ছিল।

গত দুই বছরে গুরুত্বপূর্ণ অসংখ্য তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা হিসেবে পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে পরিদর্শকদের সরিয়ে দিয়েছেন মোহাম্মদ আলী। অর্থাৎ যেসব কর্মকর্তা তার অনিয়ম ও দুর্নীতিতে পথের কাঁটা ছিল, বা যাদের তিনি বাঁধা মনে করতেন, তাদের অন্য জায়গায় সরিয়ে দিতেন। সেখানে নিয়ে আসতেন তার বশংবদ কর্মকর্তাদের।

জানা যায় যে মোহাম্মদ আলী মিয়ার সহযোগী এবং ক্যাশিয়ারদের মধ্যে একজন ছিলেন বিসিএস ২৭ ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা ইমরান ভূঁইয়া। এই কর্মকর্তা চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় এএসপি হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন, তার বিরুদ্ধে বিদেশী একটি গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেই অভিযোগে ইমরানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে এবং বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দমনে দক্ষতা দেখিয়ে তিনি বিভাগীয় মামলা থেকে রক্ষা পান। এরপর ইমরানকে পুলিশ সুপার পদেও পদোন্নতি দেওয়া হয়।

ইমরান প্রাক্তন সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলীর সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ছিলেন। মোহাম্মদ আলী নিজেই তাকে সিআইডিতে নিয়ে এসেছিলেন। সিআইডির ফরেনসিক ইউনিটে পদায়ন হলেও মোহাম্মদ আলীর করুণায় তাকে আরও দুটি ইউনিটের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ইমরান ভূঁইয়া মূলত মোহাম্মদ আলীর ঘুষের টাকার ক্যাশিয়ার ছিলেন।

মোহাম্মদ আলীর নির্দেশে বিভিন্ন ব্যক্তির নামের একটি তালিকা তৈরি করা হয় এবং অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে তাদের সিআইডিতে তলব করা হয়। ইমরানের সাথে আরও দুজন পুলিশ সুপার ছিলেন। এই তিনজন মোহাম্মদ আলীর উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন। তাদের পরামর্শে অর্থ পাচারের অভিযোগে ১০০ জন ব্যবসায়ীর একটি তালিকা তৈরি করা হয়।তালিকা অনুযায়ী ওই সব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের সিআইডিতে তলব করে চিঠি পাঠান তারা।

এভাবে, প্রাক্তন সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মামলার ভয় দেখিয়ে বা মামলায় ফাঁসিয়ে সিন্ডিকেট গঠন করে অর্থ সংগ্রহ করতেন। যদি তার অনৈতিক আদেশ পালন না করা হত, তাহলে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বদলি বা কোণঠাসা করে দিতেন।

মোহাম্মদ আলী মিয়া রিং আইডি থেকে ঘুষ নিয়েছিলেন

বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, দীর্ঘ তদন্তের পর সিআইডি প্রাথমিক দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে ই-কমার্স কোম্পানি রিংআইডির মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। রিংআইডির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফুল ইসলাম, তার স্ত্রী ও সিইও আইরিন ইসলাম, এবং তার ভাই ও পরিচালক সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের কাছ থেকে ৩০২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৭.৪৯ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে। তবে তদন্ত কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান আদালতে জমা দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে মূল অভিযোগকে ‘তথ্যগতভাবে ভুল’ বলে উল্লেখ করেছেন।

গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আদালতে জমা দেওয়া রিপোর্টে সিআইডি জানায়, শরীফুল, আইরিন ও সাইফুলের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রতারণামূলকভাবে টাকা আদায়, তা আত্মসাৎ, শেয়ারবাজারে অবৈধ বিনিয়োগ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টাকা স্থানান্তর বা বিদেশে অর্থপাচারের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

অভিযোগ রয়েছে, মোহাম্মদ আলী এই মামলার আসামিদের দায়মুক্তি দেওয়ার জন্য ১০ কোটি টাকা ঘুষ নেন, যা গুলশানের এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর মাধ্যমে দুবাইয়ে পাচার করা হয়।

অবৈধ সম্পদের পাহাড়

মোহাম্মদ আলী মিয়া তার নিজের এবং অন্যদের নামে ঢাকার আফতাবনগর, বাড্ডা, মিরপুর ও পূর্বাচল এলাকায় বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন। এসব সম্পদের মধ্যে রয়েছে প্লট, অ্যাপার্টমেন্ট ও অন্যান্য স্থাবর সম্পত্তি। তিনি লন্ডন ও দুবাইতেও রিয়েল এস্টেট ব্যবসা পরিচালনা করেন।

তদন্তে দেখা গেছে, ঢাকায় তার মালিকানাধীন বেশ কিছু মূল্যবান সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্যে একটি ১২.৩৭ শতক জমি রয়েছে আফতাবনগরের কাছাকাছি আনন্দনগরে (খতিয়ান নম্বর ৪৪৩২৫, দাগ নম্বর ১৮১৩০, মৌজা: বাড্ডা)। তিনি আরও ৮.২২ শতক জমির মালিক মিরপুরের বাউনিয়া মৌজায় (খতিয়ান নম্বর ৪০৭২৩, দাগ নম্বর ৩০)। এছাড়াও পূর্বাচল ও কেরানীগঞ্জে ৫ কাঠা করে জমি এবং একাধিক বেনামে কেনা ফ্ল্যাট রয়েছে বলে জানা গেছে।

তাছাড়া মোহাম্মদ আলী মিয়া বিপুল অর্থ মালয়েশিয়া ও যুক্তরাজ্যে পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। লন্ডনে তিনি এক বাংলাদেশি নাগরিকের মালিকানাধীন রিয়েল এস্টেট কোম্পানির অংশীদার। তার একমাত্র ছেলে আফনান লাবিব লন্ডনে এই ব্যবসা পরিচালনা করেন।

তাবিথ আউয়ালকে ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র

সাবেক ও বর্তমান একাধিক সিআইডি কর্মকর্তার দাবি, মোহাম্মদ আলী বিএনপি নেতা তাবিথ আওয়াল ও তার দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের মামলা করতে তদন্ত কর্মকর্তাদের বাধ্য করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আশিকুর রহমান শুরুতে চার্জশিট দিতে রাজি ছিলেন না।

গত বছর চট্টগ্রামের হালিশহরে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ “গোল্ডটেক্স” নামে একটি কোম্পানির মালিকদের বিরুদ্ধে সরকারি বন্ড সুবিধা লঙ্ঘন করে কালোবাজারে শুল্কমুক্ত কাপড় বিক্রির অভিযোগে মামলা করে। কোম্পানিটি পাঁচজন চীনা নাগরিকের মালিকানাধীন। দায় এড়াতে মালিকরা তাদের কর্মচারী ও সিএন্ডএফ এজেন্টদের দিয়ে আশুলিয়া থানায় পাল্টা মামলা করান।

তদন্ত কর্মকর্তা এসএম মিরাজ আল মাহমুদ প্রাথমিকভাবে মালিকদের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার প্রমাণ পান। কিন্তু মোহাম্মদ আলীর নির্দেশে রিপোর্টে মালিকদের নাম বাদ দেওয়া হয়। মিরাজ তা মানতে না চাইলে তাকে ঢাকার সিআইডি সদর দফতর থেকে জামালপুর অফিসে বদলি করা হয়।

তার আমলে সিআইডি কর্তৃক নিষ্পত্তি হওয়া মামলার সংখ্যা কম।

মোহাম্মদ আলী মিয়া সিআইডির প্রধান হওয়ার পর মামলা নিষ্পত্তির হার নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়। অনেক মামলার চূড়ান্ত অনুমোদন বিলম্বিত হওয়ায় তদন্ত কর্মকর্তারা সমস্যায় পড়েন। কিছু ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ডিআইজি বা এসপি-কে না জানিয়ে তদন্ত কর্মকর্তাও পরিবর্তন করে দেন।

২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত সিআইডিতে মোট ৩৩,১১৪টি মামলা তদন্তাধীন ছিল। এর মধ্যে মাত্র ১৬,৩৮২টি নিষ্পত্তি হয়েছে। ৭,৯৪৭টি মামলার মধ্যে মাত্র ২,৮৩৫টির চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হয় এবং ১,০০৩টি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

এর আগের সময়কালে (১ সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে ৩১ জুলাই ২০২২) মোট ২৩,৬৬২টি মামলা তদন্তাধীন ছিল, যার মধ্যে ১৩,৫০৮টি নিষ্পত্তি করা হয়। সেই সময়ে ৩,৫৯৫টি চার্জশিট, ১,১৮১টি চূড়ান্ত প্রতিবেদন এবং ৮৬৭টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়। মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে ৩,১৭৪টি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে।

তার মেয়াদে সিআইডি কেবল ৩৯৮টি মামলা নথিভুক্ত করেছে। তার আগের সময়কালে সিআইডি নিজেদের উদ্যোগে ২,২০১টি মামলা দায়ের করেছিল। ইন্সপেক্টর থেকে ডিআইজি পর্যায়ের সিআইডি কর্মকর্তাদের মতে, যোগদানের পর মোহাম্মদ আলী অধীনস্থদের নিজেদের উদ্যোগে মামলা করতে নিরুৎসাহিত করেছিলেন, যার ফলে এই হ্রাস ঘটে।

দুদক মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে তদন্ত করছে

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবেক সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়ার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে। গত ১৩ মার্চ দুদক মোহাম্মদ আলী ও আরও পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়, যারা তার দুর্নীতিতে সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন: পুলিশ সুপার (অ্যাডমিন) মিনহাজুল ইসলাম, স্পেশাল সুপার (ঢাকা মেট্রো পশ্চিম) এ কে এম ইমরান ভূঁইয়া, অ্যাডিশনাল এসপি (সাইবার ক্রাইম) জুয়েল চাকমা, ইন্সপেক্টর মানব শাহজাদা ও ইন্সপেক্টর মনিরুজ্জামান।