মিয়ানমার ঘোষণা করেছে যে ১,৮০,০০০ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত। এই তথ্য BIMSTEC (বিমসটেক) সম্মেলনের সময় প্রধান উপদেষ্টার অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে দেওয়া একটি স্ট্যাটাসে প্রকাশ করা হয়েছে। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের এই উদ্যোগ সহজে সামনে আসেনি। সম্মেলনের সময়ও মিয়ানমারের প্রতিনিধি রোহিঙ্গাদের ‘অবৈধ বাঙালি’ বলে উল্লেখ করলে বাংলাদেশ প্রাথমিকভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসতে অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তীতে মিয়ানমার তাদের অবস্থান পরিবর্তনে বাধ্য হয়।
শনিবার (৫ এপ্রিল) প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার তার ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দেন। তিনি প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খালিলুর রহমানের কৌশলী ভূমিকাকে প্রশংসা করেন, যার ফলে মিয়ানমার ১,৮০,০০০ রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের জন্য গ্রহণ করতে রাজি হয়েছে।
ফেসবুক পোস্টে ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি উল্লেখ করেন, “দুই দশকের কাছাকাছি সময় ধরে আমি রয়টার্স, EFE, এবং ওয়াশিংটন পোস্টসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে রিপোর্ট করেছি। ২০১৭ সালের গণহত্যার পর থেকে আমি তাদের নিপীড়ন ও দুর্দশা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন করে এসেছি—ক্যাম্পের প্রতিটি কোণায় ঘুরেছি, তাদের কান্নার প্রতিটি সুর শুনেছি।
কিন্তু কখনও কল্পনাও করিনি যে আমি এই সংকটে এমন এক মোড় দেখতে পাব—যা মনে করি অবশেষে প্রত্যাবাসনের বহু প্রতীক্ষিত দরজাটি খুলে দেবে।”
তিনি লেখেন, “গতকাল ব্যাংককে BIMSTEC সম্মেলনে মিয়ানমারের নেতা রোহিঙ্গাদের ‘অবৈধ বাঙালি’ বলায় বাংলাদেশ প্রথমে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে মিয়ানমার যখন ১,৮০,০০০ রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত হিসেবে স্বীকার করে, তখনই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।”
খালিলুর রহমানের প্রশংসা করে তিনি যোগ করেন, “যেভাবে হাই লেভেল রিপ্রেজেন্টেটিভ খালিলুর রহমান পুরো প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করেছেন, আমি তাতে অভিভূত। এমনকি তিনি মিয়ানমার কর্মকর্তাদের মুখ থেকে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারিত করতেও সফল হয়েছেন—এটি সাধারণ কূটনৈতিক প্রচেষ্টার চেয়ে অনেক বড় অর্জন। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন।”
উল্লেখযোগ্য যে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া নিবন্ধিত ১,৮০,০০০ রোহিঙ্গাকে প্রথম ধাপে প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি আরও ৭০,০০০ রোহিঙ্গা বর্তমানে চূড়ান্ত যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
শুক্রবার (৪ এপ্রিল) মিয়ানমারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ইউ থান শোয়ে এই তথ্য জানান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ প্রতিনিধি খালিলুর রহমানকে। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে চলমান BIMSTEC সম্মেলনের সাইডলাইনে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বলে প্রধান উপদেষ্টার অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে জানানো হয়েছে।
ফেসবুক পোস্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ৮ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশকে জানিয়েছে যে তারা ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের জন্য উপযুক্ত হিসেবে শনাক্ত করেছে। ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ছয়টি ধাপে এই প্রাথমিক তালিকা দিয়েছিল।
পোস্টে আরও বলা হয়েছে, অতিরিক্তভাবে আরও ৭০ হাজার রোহিঙ্গার ছবি ও নাম বিশেষভাবে যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত যাচাই প্রক্রিয়া চলছে।
পোস্টে উল্লেখ করা হয়, এটি প্রথম নিশ্চিত তালিকা, যা রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথে একটি বড় অগ্রগতি। মিয়ানমার পক্ষ জানিয়েছে, মূল তালিকায় থাকা বাকি ৫ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গার যাচাই প্রক্রিয়াও দ্রুত শেষ করা হবে।
মিয়ানমারে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রতিনিধি বৈঠকে বলেন, বাংলাদেশ দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য আরও মানবিক সহায়তা পাঠাতে প্রস্তুত।
এর আগে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়নের মুখে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। পরবর্তী কয়েক মাসে ৭ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয়। এর আগে ওই এলাকায় প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা বিভিন্ন শিবিরে বসবাস করছিল। জন্মনিয়ন্ত্রণে সাধারণ অনীহার কারণে প্রতিদিন প্রায় একশ’ শিশু ওই শিবিরগুলোতে জন্ম নেয়। এই উচ্চ জন্মহারের ফলে ২০২২ সালের মধ্যে শিবিরে রোহিঙ্গার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ লাখে, এবং উখিয়ার কুতুপালং হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির।
আন্তর্জাতিক চাপে, ২০১৭ সালের শেষ দিকে মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সম্মত হয়। একই বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। পলাতক রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাই ও অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা শেষে ২০১৯ সালে দুইবার প্রত্যাবাসনের চেষ্টা হয়; তবে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতিতে আস্থা না থাকায় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
কোভিড-১৯ মহামারির সময় রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বৈশ্বিক মনোযোগও কমে যায়। এ অবস্থায়, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের জেনারেল মিন অং হ্লাইং-এর নেতৃত্বাধীন সামরিক জান্তা সু চি সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও এক ধাক্কা খায়। চীনের মধ্যস্থতায় কয়েকটি প্রত্যাবাসনের উদ্যোগও ব্যর্থ হয়। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘর্ষ বেড়ে যাওয়ায় প্রত্যাবাসন আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়। উল্টো রাখাইনে নতুন করে সংঘাত শুরু হওয়ায় আবারও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ শুরু হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, নতুন করে আরও ৮০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
চলতি বছরের ১৪ মার্চ, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেন। ওই দিন ১ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতারে অংশ নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, “সমাধান অবশ্যই মিয়ানমারেই খুঁজে পেতে হবে। এখানে থাকা শরণার্থীদের জন্য স্বেচ্ছাসেবামূলক, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের পরিবেশ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামব না।”
একই অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করবে যেন রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ফিরে গিয়ে আগামী বছর সেখানে ঈদ উদযাপন করতে পারে।