চিনের প্রেসিডেন্টের পাঠানো বিমানে যে বিশেষ লক্ষ নিয়ে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা

আজ (২৬ মার্চ), অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীনে একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সফরে যাচ্ছেন। তিনি চীনা রাষ্ট্রপতির পাঠানো একটি বিশেষ বিমানে দেশটিতে ভ্রমণ করবেন। এই সফরের মাধ্যমে তিনি ঢাকা ও বেইজিংয়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করার লক্ষ্যে কাজ করবেন। ড. ইউনূসের এই সফর বিশেষ করে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প এবং বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা।

সফরের উদ্দেশ্য
ড. ইউনূসের সফরের মূল লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও জোরদার করা। ঢাকার পক্ষ থেকে চীনের সঙ্গে নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর ইচ্ছা রয়েছে। বিশেষত, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়ন এবং চীনের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে অংশগ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।

সফরের শুরুতে, আগামীকাল, ২৭ মার্চ, ড. ইউনূস চীনের হাইনান প্রদেশে অনুষ্ঠিত বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া (বিএফএ) সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন। তিনি সম্মেলনে ভাষণ দেবেন এবং সম্মেলনের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ চীনা রাষ্ট্রনেতাদের সাথে বৈঠক করতে পারেন। পরে, ২৮ মার্চ, তিনি বেইজিংয়ে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের সাথে সাক্ষাত করবেন, যেখানে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে।

এরপর, ২৯ মার্চ, চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটি থেকে ড. ইউনূসকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হবে, যেখানে তিনি একটি বক্তৃতাও দেবেন। তার সফরে মোট ৫৭ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল তার সঙ্গে থাকছে, যা সফরের গুরুত্বের আরও একটি প্রমাণ।

চীনের সাথে সম্পর্ক আরও গভীর করার সুযোগ
এটি ড. ইউনূসের প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর, এবং বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে এটি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন যে এই সফর বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ঐতিহাসিক সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করছে, যা দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার একটি দুর্দান্ত সুযোগ তৈরি করবে।

বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক অনেকটা গভীর এবং বিস্তৃত হয়েছে। বিশেষত চীন বাংলাদেশের বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে অংশগ্রহণ করছে। বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে চীন থেকে ঋণ নিচ্ছে এবং চীনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এখন চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে পরিচিত।

চীনের ঋণ সুবিধা এবং প্রকল্প সহযোগিতা
এই সফরের সময়, বাংলাদেশ কর্তৃক চীন সরকারের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুরোধ করা যেতে পারে – অর্থাৎ, চীনের ঋণ পরিশোধের সময়কাল ৩০ বছর পর্যন্ত বাড়ানো এবং ঋণের সুদের হার কমানোর বিষয়ে আলোচনা করা। বিশেষ করে বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের প্রেক্ষাপটে, এই ঋণ সুবিধাগুলি বাংলাদেশের জন্য অনেক উপকারী হতে পারে।

চীন সফরের রাজনৈতিক তাৎপর্য
বিশ্ব রাজনীতির আলোকে, বিশেষত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ-চীনের সম্পর্কের কারণে এই সফরের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের মধ্যে সম্প্রতি কিছু টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ড. ইউনূসের চীন সফর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমিয়ে নতুন এক স্তরে পৌঁছাতে সাহায্য করবে।

চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনও এই সফর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “এই সফর বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হবে।”

এছাড়াও, প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, চীনে সম্পর্কের গতির ‘একটি ছেদ’ পড়েছে এবং এই সফর বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য
বাংলাদেশ বর্তমানে অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে রয়েছে এবং চীনের মতো শক্তিশালী অর্থনৈতিক অংশীদার পেয়ে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হতে পারে। বিশেষ করে, বাংলাদেশকে চীন তার বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে আরও বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করতে পারে। এছাড়া, চীনের কাছ থেকে কিছু শিল্প ও প্রযুক্তিগত সহায়তা পেলে বাংলাদেশের জন্য তা নতুন উন্নয়ন সম্ভাবনা তৈরি করতে সহায়ক হতে পারে।

যেহেতু চীন বাংলাদেশের জন্য একটি প্রধান অর্থনৈতিক অংশীদার, সেখানে বাংলাদেশের আমদানি খরচ কমানোর জন্য চীনের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়া যেতে পারে, যা বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবেলায় সহায়ক হবে।

ভবিষ্যতের রাজনৈতিক প্রভাব
ভারত ও চীনের মধ্যে আঞ্চলিক আধিপত্য নিয়ে বিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে, চীনের সাথে সম্পর্ক গভীর করার বাংলাদেশের উদ্যোগ ভারতের সাথে সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা মনে করেন যে এই সফর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য খাতকে আরও লাভবান করার সম্ভাবনা বেশি।

অধ্যাপক সৈয়দা রোজানা রশিদ বলেন, “এই সফরের প্রতীকী গুরুত্ব রয়েছে। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করবে এবং চীনের সাথে সহযোগিতার নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে।”


পর্যটন মন্ত্রণালয়ে ঘাপটি মেরে থাকা প্রতারক সিন্ডিকেটের পর্দা ফাঁস

পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব জিনিয়া জিন্নাত এবং তার কথিত স্বামী আশরাফুজ্জামান ওরফে মিনহাজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম, দুর্নীতি, মামলা-মোকদ্দমা, হয়রানি, অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন এবং পাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগে আরও বলা হয়েছে যে, তারা আমলা, পুলিশ, রাজনীতিবিদ এবং বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে এই অপরাধ করেছেন।

রবিবার (২৩ মার্চ) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুর্নীতি দমন কমিশনে একজন ভুক্তভোগী এই অভিযোগ দায়ের করেছেন। ৪০ পৃষ্ঠার চার্জশিটে ওই ব্যক্তি মোট ১৩টি অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগে বলা হয়েছে যে, পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব জিনিয়া জিন্নাত এবং তার কথিত স্বামী আশরাফুজ্জামান ওরফে মিনহাজ উদ্দিন ক্ষমতার অপব্যবহার, জালিয়াতি, প্রতারণা, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং নিরপরাধ মানুষকে মামলায় ফাঁসিয়ে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন, পাচার এবং হয়রানি করে আসছেন। তদন্তের পর তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন।

অভিযোগে বলা হয়েছে যে, আশরাফুজ্জামান নামের ওই ব্যক্তির উত্থান শুরু হয় ২০০৮ সালে। ২০০৯ সালে সাহারা খাতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার আগে, আশরাফুজ্জামান ওরফে মিনহাজ উদ্দিন তার পরিবারের এক সদস্যকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেন। ২০০৯ সালে সাহারা খাতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর, তিনি তার পরিবারের জামাতা পরিচয় দিয়ে সচিব, পুলিশ, বিচার বিভাগ এবং বিভিন্ন বাহিনীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং জনগণের সাথে প্রতারণা করে চাঁদাবাজি করা তার পেশায় পরিণত হয়।

তার প্রধান কাজ ছিল পুলিশ, আমলা এবং বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করা এবং তারপর মামলা থেকে রক্ষা করার নামে ভুক্তভোগীর পরিবার থেকে টাকা আদায় করা।

এ ছাড়া কর্মকর্তাদের বিপদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নেওয়াও হয়ে ওঠে তার পেশা। অপরাধ সম্পন্ন করতে যখন যাকে প্রয়োজন তাকে ব্যবহার করেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের পরিবারের জামাই পরিচয় ব্যবহার করায় সাহারা খাতুন নিজেই তাকে একবার কারাগারে পাঠিয়েছিলেন।

ওই ব্যক্তি নিজেকে ডক্টর দাবি করলেও তা ভুয়া। অপরাধের টাকা বিদেশে পাচার করার অভিযোগও রয়েছে তার এবং জিনিয়া জিন্নাতের বিরুদ্ধে। ৯৬টির বেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য পাওয়া যায় আশরাফুজ্জামান মিনহাজের। মানুষকে বিপদে ফেলে টাকা নেওয়া হয়ে গেলে ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে অ্যাকউন্টগুলো বন্ধ করে দেন তিনি।

মিনহাজ উদ্দিন নামের এই প্রতারক বেশিরভাগ সময় বিভিন্ন সার্কিট হাউসে থাকে। জিনিয়া জিন্নাত ও তাহমিনা আক্তার তিন্নি, এক নারী জজ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের পরিবারের এক সদস্য ও বিদেশে থাকা এক নারীকে জায়গা বুঝে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে থাকেন তিনি।

তবে, এই মহিলাদের মধ্যে কেবল জিনিয়া জিন্নাতই টাঙ্গাইলের সহকারী ভূমি কমিশনার নাজমুল হাসানের কাছে মিনহাজ উদ্দিন নামের একজন ব্যক্তিকে তার স্বামী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। জিনিয়া জিন্নাত এবং ওই ব্যক্তি একাধিক নাম এবং একাধিক জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট ব্যবহার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগ করা হয়েছে যে জিনিয়া জিন্নাতের বাবা একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন কিন্তু তিনি সেই কোটায় বিসিএস ক্যাডার হয়েছিলেন। এবং জিনিয়া জিন্নাতের কথিত স্বামী মিনহাজ উদ্দিনও জিনিয়া জিন্নাতের বাবাকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানাতে সহায়তা করেছিলেন।

অভিযুক্ত মিনহাজ উদ্দিন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের মিরওয়ারিশপুরে আসাদ মিয়ার বাড়ির মো. হারুন অর রশিদের ছেলে। আর পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব জিনিয়া জিন্নাত বরিশালের বাবুগঞ্জের রাকুদিয়া গ্রামের রতন আলী শরীফের মেয়ে। রত্তন আলী শরীফ নিজেকে বীর প্রতীক দাবি করলেও অভিযোগে বলা হয়েছে তিনি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা।

প্রভাবশালী নারী, সচিব, ম্যাজিস্ট্রেট, জজ, বিচারপতি, রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে তাদের ব্যবহার করে অপরাধ ও প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় আশরাফুজ্জামান ওরফে মিনহাজ উদ্দিনে পেশা।

১৩টি অভিযোগের মধ্যে প্রথমটিতে বলা হয়েছে যে তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা না হলেও তার মেয়ে জিনিয়া জিন্নাত মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন। সহকারী কমিশনার ভূমি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদ থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার পর তিনি বর্তমানে পর্যটন মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব। তদন্ত সাপেক্ষে তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। জিনিয়া জিন্নাতের পিতা রত্তন শরীফ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে বীর প্রতীক দাবি করে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন।

তিনি শেখ হাসিনার দেওয়া বীর প্রতীক উপাধি, কর্পোরাল ব্যবহার করেছেন, যার অর্থ তিনি সেনাবাহিনী থেকে মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করেছেন। গেজেটে তিনি দাবি করেছেন যে তিনি বিমান বাহিনী থেকে মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করেছেন এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন।

আবার, আরেকটি গেজেটে তিনি দাবি করেছেন যে তিনি পুলিশ বাহিনী থেকে মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করেছেন। অভিযোগ রয়েছে যে রতন শরীফ একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম ব্যবহার করে নিজেকে বীর প্রতীক বলে দাবি করেছেন অথবা নিজেকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দায়ী করেছেন। আরও অভিযোগ রয়েছে যে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পর, তিনি তার কথিত স্বামীর সাথে মামলা-মোকদ্দমা এবং ব্যবসা সহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত।

দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে যে, টাঙ্গাইলের গোপালপুরের প্রাক্তন সহকারী কমিশনার (ভূমি) জিনিয়া জিন্নাত তার অনাগত সন্তানকে অনৈতিক সম্পর্কের কারণে হত্যা করেছিলেন, যদিও তার স্বামী অজ্ঞাত ছিলেন, যা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ, কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জিনিয়া জিন্নাতের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তিনি টাঙ্গাইলের গোপালপুরে সহকারী ভূমি কমিশনার থাকাকালীন অনৈতিক সম্পর্কের কারণে তার অনাগত সন্তানকে গোপনে হত্যা করেছিলেন। শিশুটির বাবা কে তা নিশ্চিত না হলেও, জিনিয়া জিন্নাত গোপনে অনাগত শিশুটিকে হত্যা করার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন।

টাঙ্গাইলের আড়াইশ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল গাইনি বিভাগের ওয়ার্ড নম্বর ডব্লিউ থ্রি’র (W-3) বি-১০ নম্বর বেডে ২০১৮ সালের ১ আগস্ট থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত দুদিন এ কারণে ব্যবহার করেন জিনিয়া জিন্নাত। রোগীর ছাড়পত্রে স্বামীর নাম নেই। এ জন্য অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ১২ আগস্ট থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৪ দিন ছুটি কাটান। ছুটি ভোগের প্রায় মাস পরে অসুস্থকালে ছুটি মঞ্জুরের নথিতে ২০১৮ সালের ১২ নভেম্বর স্বাক্ষর করেন তৎকালীন টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল ইসলাম। দেশে গর্ভের সন্তান হত্যা (দণ্ডবিধিতে ধারা ৩১২-৩১৬) শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তা সত্ত্বেও জিনিয়া জিন্নাত ও তার অনৈতিক সঙ্গীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হাসপাতালের নথিতে স্বামীর কোনো তথ্য নেই। যদিও এটি পুলিশ কেস তবুও গোপনে এমন অপরাধ ঘটিয়েছেন জিনিয়া জিন্নাত।

তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে যে জিনিয়া জিন্নাতের স্বামী, নির্বাহী কর্মকর্তা, নিজে ম্যাজিস্ট্রেটের পোশাক পরে অভিযানে যেতেন। তিনি গাড়ি জব্দ করতেন, জরিমানা করতেন এবং টাকা আদায় করতেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার স্ত্রী, জিনিয়া জিন্নাত নিজেই সহযোগিতা করতেন।

নরসিংদীর শিবপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থাকাকালে জিনিয়া জিন্নাতের কথিত স্বামী তার সরকারি গাড়ি ও গানম্যান ব্যবহার করে নিজেই ম্যাজিস্ট্রেট সেজে বেরিয়ে পড়তেন অভিযানে। পরিচালনা করতেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। দুটি গাড়ি জব্দ করেন দুলালপুর থেকে এবং সেগুলো আলাদা ড্রাইভার দিয়ে নিজের হেফাজতে নেন, বিষয়টি নিয়ে জিনিয়া জিন্নাতকে শোকজও করা হয়েছিল; ফলাফল শূন্য। এ ছাড়া সেই কথিত স্বামী বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করেছেন। চালকদের পাঠিয়ে গাড়িতে বসে থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয়ে চাঁদা আদায় করতেন তার কথিত স্বামী।

তিনি সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতেন। তিনি টাকা না দিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার এবং ব্যক্তিগত গাড়িতে জ্বালানি নিতেন এবং চালককে পাম্প রেজিস্টারে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করতেন। ওই ব্যক্তি মদ্যপ অবস্থায় পানশালায়ও যেতেন। যারা এই অপরাধের সাথে একমত হতেন না তাদের তিনি মিথ্যা অভিযোগে টাকা না দিয়ে চাকরিচ্যুত করতেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিনিয়া জিন্নাত এই সমস্ত অপরাধে সহযোগিতা করতেন। অভিযোগ রয়েছে যে জিনিয়া জিন্নাত অফিসেও ঠিকমতো কাজ করতেন না।

চার নম্বরে অভিযোগে বলা হয়েছে, বেতন দেওয়ার পরিবর্তে অপরাধ জায়েজ করতে মিথ্যা অভিযোগে চালককে বেতন না দিয়ে চাকরি থেকে অপসারণ করেছেন জিনিয়া জিন্নাত। শিবপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থাকাকালে জিনিয়া জিন্নাত তার কথিত স্বামীর কথায় পৌরসভার সরকারিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ড্রাইভারকে বেতন ভাতা না দিয়ে ডিউটিকালে তার কাছ থেকে নানাভাবে টাকা নিতেন। এখনও তার কাছে ওই চালক রোবেল মিয়ার চার লাখের বেশি টাকা পাওনা। কথিত স্বামী পরিচয় দেয়া ব্যক্তির অপরাধ জায়েজ করতে রোবেল মিয়াকে অন্যায়ভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে চাকরিচ্যুত করেন জিনিয়া জিন্নাত। চাকরি ফিরে চাইতে গেলে চালককে ঘাড় ধরে বের করে দেন।

পঞ্চম অভিযোগে বলা হয়, তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে কথিত স্বামীকে নিয়ে সরকারি গাড়ি ও প্রটোকল নিয়ে ঘুরতেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। খরচ নিতেন চালক ইদ্রিসের কাছ থেকে। পরে বেতন না দিয়েই সেই চালককে অপসারণ করা হয়। জিনিয়া জিন্নাত নরসিংদীর শিবপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থাকাকালে অফিস শেষে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কথিত স্বামীকে নিয়ে দেশের বিভিন্নস্থানে প্রটোকল নিয়ে ঘুরতেন। গাড়ির জ্বালানী এবং আনসার সদস্য ও তাদের যাবতীয় খরচ বহন করতে হতো চালককে। ওই চালককে নিয়ে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করে তিনি নোয়াখালী গিয়েছিলেন কথিত স্বামীর সাথে। কিন্তু শেষপর্যন্ত বেতন না দিয়ে চাকরি থেকে বের করেন দেন সেই চালককে। চালক মো. ইদ্রিস আলীও প্রায় দুই লাখের ওপরে পাওনা।

ছয় নম্বর অভিযোগে বলা হয়, সরকারি গাড়ি মেরামতের টাকা ও জ্বালানি খরচের টাকা পরিশোধ না করে উল্টো চালককে মিথ্যা শোকজ দিয়ে সরকার চাকরি খেয়েছেন জিনিয়া জিন্নাত। এসবের পেছনে ছিলেন কথিত স্বামী মিনহাজ উদ্দিন। নরসিংদীর শিবপুরে সরকারি গাড়ি মেরামতের খরচ না দিয়ে গাড়ির পার্টস ও ইঞ্জিন নাড়া-চাড়া করে চালক রোবেল গাড়ি নষ্ট করেছে এমনসহ নানা অভিযোগে শোকজ করেন জিনিয়া জিন্নাত। পাশাপাশি সরকারি ও ব্যক্তিগত গাড়িতে জ্বালানি নিয়ে তিনি তাতে সই করাতেন চালক রোবেলকে দিয়ে। পরে সেই টাকাও পরিশোধ না করে চালকের ওপর দোষ চাপান এবং মিথ্যা মামলারও হুমকি দেন। পরে শোকজের মাধ্যমে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। চাকরি ফেরত, ক্ষতিপূরণ এবং জিনিয়া জিন্নাত ও তার কথিত স্বামীর শাস্তি চান ভুক্তভোগীরা।

সাত নম্বর অভিযোগে বলা হয়, কোরবানির কসাইয়ের টাকাও পরিশোধ করেননি কথিত স্বামী ও জিনিয়া জিন্নাত। নরসিংদীর শিবপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থাকাকালে কোরবানীর দিয়ে কসাইয়ের টাকাও পরিশোধ করেননি জিনিয়া জিন্নাত ও তার কথিত স্বামী। চরম খারাপ আচরণের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

আট নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, জিনিয়া জিন্নাতের নির্দেশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বহিরাগত হয়েও তার স্বামী লোকজন নিয়ে সহকারী কমিশনার ভূমির চেয়ারে বসে খাবার গ্রহণ করেছেন। এ ঘটনা ঘটে ২০২৪ সালের ৪ জানুয়ারি। টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার ভূমির ওই অফিসের সাবেক সহকারী কশিমনার (ভূমি) জিনিয়া জিন্নাতের কথিত স্বামী এ ঘটনা ঘটান। তার কথিত স্বামী গোপালপুর ভ্রমণে যাবেন এ কারণে ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার সকল বন্দোবস্ত করার জন্য আগেই জিনিয়া জিন্নাত নির্দেশ দেন তৎকালীন ভূমি সহকারী কমিশনার নাজমুল হাসানকে। সাধারণ ব্যক্তি হয়েও কথিত স্বামী কমিশনারের জায়গায় বসে সবাইকে নিয়ে খাবার গ্রহণ ও ছবি তোলেন। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন নাজমুল হাসান। ক্ষমতার অপব্যবহার করে এমন ঘটনা অপরাধ ঘটালেও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

নয় নম্বরে বলা হয়, স্ত্রী ম্যাজিস্ট্রেট তাই স্ত্রীর সহায়তায় মামলা বাণিজ্য করেন কথিত স্বামী। নীরিহ মানুষের নাম মামলায় যুক্ত করে সেই মানুষকে মামলা থেকে বাঁচানোর নামে টাকা আদায় তার ব্যবসা। নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্নস্থানে বহু মানুষকে হয়রানি করছেন তারা। নোয়াখালীতে নিজ এলাকায় অন্তত ১০ জনকে তিনি মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ রয়েছে। এমন কী নিজের পিতা হারুনুর রশিদকে মামলা দিয়ে জেল খাটিয়েছেন আশরাফুজ্জামান মিনহাজ ও জিনিয়া জিন্নাত চক্র।

১০ নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, নিজের জবাবসহ শাস্তি এড়াতে ডিসি অফিস ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস থেকে নিজের বিরুদ্ধে শোকজের নথি সরিয়ে ফেলেছেন জিনিয়া জিন্নাত। যদিও সরকারি গাড়ি ব্যবহার এবং সরকারি ফোন নিয়ে ভারতে প্রশিক্ষণে যাওয়ার অনিয়মের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল, তবুও মামলার সমস্ত ফাইল এবং জবাব সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ১ জুন ২০২৩ তারিখে ভারতে সরকারি মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে শোকজ করা হয়। শোকজ থাকলেও জবাব সরিয়ে ফেলেছেন। নরসিংদীর শিবপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থাকাকালে তাকে এসব শোকজ করা হয়, যা প্রভাব খাটিয়ে সরিয়ে ফেলেন।

অভিযোগ নম্বর ১১-এ বলা হয়েছে যে জিনিয়া জিন্নাত এবং তার কথিত স্বামী ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। এই দুজন এতটাই বিপজ্জনক এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন যে জিনিয়া জিন্নাতের বদলির খবরে নরসিংদীর শিবপুরের সাধারণ মানুষ মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন।

অভিযোগ নম্বর ১২ অনুসারে, আশরাফুজ্জামান ওরফে মিনহাজ উদ্দিন নিজেকে কানাডার ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক বলে দাবি করেছিলেন। কিন্তু তার দেওয়া তথ্য অনুসারে, তিনি ২০১০ সাল থেকে গবেষক এবং ২০১১ সাল থেকে সেখানে একজন ছাত্র হিসেবে কাজ করছেন। অর্থাৎ শিক্ষার্থী হওয়ার আগেই শিক্ষক সেজে বসে আছেন।