Friday , November 15 2024
Breaking News
Home / Crime / উদঘাটিত হলো ‘মাদকসম্রাজ্ঞী’ রহিমার ভয়ঙ্কর অপরাধ সাম্রাজ্য

উদঘাটিত হলো ‘মাদকসম্রাজ্ঞী’ রহিমার ভয়ঙ্কর অপরাধ সাম্রাজ্য

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও সারাদেশের তরুণ সমাজের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাবকে দমন করতে গত কয়েক বছর ধরেই সরকারি নানা উদ্যোগে পরিচালিত হয়েছিলো মাদকবিরোধী অসংখ্য অভিযান। কিন্তু ঢাকঢোল পিটিয়ে করা এসব অভিযানে যে কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি তার প্রমাণ মেলে বারবার। প্রায়শই সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে মাদক চোরাচালানকারী গ্যাংয়ের সংঘবদ্ধ অপরাধ কাহিনি। এমনই এক ঘটনা সম্পর্কে আরো একবার জানা গেলো আজ।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গেণ্ডারিয়া, দয়াগঞ্জ, মীরহাজিরবাগে ‘মাদকসম্রাজ্ঞী’ হিসাবেই পরিচিত রহিমা বেগম। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক কারবারি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় মাদকসম্রাজ্ঞীদের মধ্যে এক নম্বরে আছেন রহিমা বেগম। ২ যুগ ধরে মাদক ব্যবসা করে আসা রহিমা একসময় গাঁজার পুরিয়া বিক্রি করতেন। এখন মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে ঢাকার পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করেন তিনি।

নিজে চলাফেরা করেন বিলাসবহুল একাধিক গাড়িতে, আছে তার রাজধানীর সর্বত্র বিশাল মাদক সিন্ডিকেট। এ অপরাধীর ব্যাপারে গেণ্ডারিয়া এলাকার বাসিন্দারা জানান, রহিমার স্বামী এক ডজন মামলার আসামি হযরত ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার পর লাপাত্তা ছিলেন কিছুদিন। বর্তমানে আবার তিনি তার অবস্থান জানান দিতে মাঝেমধ্যে হুটহাট এলাকায় এসে সময় কাটিয়ে যান। তবে এখন খুব কৌশলে চলাফেরা করেন। আস্তানায় সময় কাটানোর ক্ষেত্রে তার নিজস্ব নিরাপত্তাব্যবস্থা ঠিকঠাক থাকলেই কেবল সে এলাকায় আসেন। কোথাও যাওয়ার আগে তার প্রধান ক্যাশিয়ার জশিমের নেতৃত্বে নিরাপত্তাকর্মীরা মোটরসাইকেল নিয়ে আগে রাস্তার পরিস্থিতি রেকি করে তাকে সিগন্যাল দিলে এরপর আগে-পিছে সাত-আটটি মোটরসাইকেলে ১২-১৪ জন দেহরক্ষী নিয়ে তবেই রহিমা কোনো গন্তব্যে পা বাড়ান।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন তথ্যসূত্রের হিসাব অনুযায়ী, তার কয়েকটি স্পটে প্রতিমাসে তিনি অন্তত ২ কোটি টাকার মাদক বিক্রি করেন। বর্তমানে রহিমা দক্ষিণ বনশ্রীতে ভিন্ন কৌশলে এবং ভিন্ন পরিচয়ে অবস্থান করছেন বলে নিশ্চিত করেছে একটি সূত্র। তার সব মাদক এবং টাকা হিসাবের জন্য ক্যাশিয়ার হিসাবে রয়েছেন তার বোনের মেয়ের জামাই খিলগাঁও-রামপুরার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী জশিম।

রহিমার নিজস্ব কিলার বাহিনী

এই নারীর ব্যবসার পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে তাকে দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেন। গেণ্ডারিয়াতে রয়েছে রহিমার নিজস্ব ক্যাডার এবং কিলার বাহিনী, যারা মাদক ব্যবসা দেখভাল করে। নামাপাড়া ছোবাপট্টি বস্তিতে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া মানুষের ওপর চলে নির্যাতন। তার ঘনিষ্ঠ হিসাবে রয়েছে মাহিনুর নামে এক নারী। ২০১২ সালে রহিমাকে হেরোইনসহ পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিয়েছিলেন আরেক মাদক ব্যবসায়ী সোর্স আসলাম শিকদার। এটাই ছিল তার অপরাধ। ২ বছর জেল খেটে জামিনে বের হওয়ার পর তার কিলার বাহিনী দিয়ে আসলামকে ২০১৪ সালের ৮ নভেম্বর রাতে দনিয়াতে তার নিজ বাড়িতে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সূত্র জানায়, রহিমা বেগম এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী। তার স্বামী হযরত আলীসহ (কথিত ক্রসফায়ারে নিহত) কয়েকজন সরাসরি এ হত্যায় অংশ নেন। মূলত ফেনসিডিল, ইয়াবা ও হেরোইন বিক্রির টাকার ভাগাভাগি নিয়েই বিরোধ ছিল আসলামের সঙ্গে রহিমার। সেই বিরোধ থেকেই রহিমাকে গ্রেফতার করিয়েছিলেন আসলাম।

এ হত্যার ঘটনা ছাড়াও জহির নামের একজন রহিমার একটি ইয়াবা চালানের কথা পুলিশের কাছে ফাঁস করে দিয়েছিলেন। রহিমা তার হাত-পা ভেঙে দেন। তার বাহিনীর সদস্য হিসাবে আছে সোহাগ, বাচ্চু, জশিম, গিয়াস উদ্দিন গেসু, ছয় ইঞ্চি সুমন, আরমান, দীন ইসলাম দেলা ওরফে রুটি খাওয়া দেলা, মনির হোসেন, মনিরুল ইসলাম রবিন ও বেবী।

নামে-বেনামে অঢেল সম্পদের পাহাড়

ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ১০টি বাড়ির মালিক। চলাফেরা করেন দামি গাড়িতে। ব্যাংকেও রেখেছেন অঢেল টাকা। এর মধ্যে ৩ নম্বর পারগেণ্ডারিয়ায় অবস্থিত তিনতলা বাড়ি, ফতুল্লার ভুঁইগড় এলাকায় ৮ তলা বাড়ি, দক্ষিণ বনশ্রীর বি-৭৬ এবং ডি-৪ নম্বর বাড়িতে দুটি মার্কেট। রাজধানীর গেণ্ডারিয়া ও শনিরআখড়া এলাকায় তিনটি বাড়ি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন জানান, অনেক সম্পত্তি ‘আত্মীয়দের নামে থাকায় বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।’

ধরাছোঁয়ার বাইরে রহিমা

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, রহিমার নামে একটি হত্যা মামলাসহ দেড় ডজন মামলা রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা কামাল হোসেন বলেন, ২০০০ সালে রহিমার দ্বিতীয় বিয়ে হয় গেণ্ডারিয়ার সন্ত্রাসী বেলবাডি হযরতের সঙ্গে। তখন থেকে দুজনে মিলে মাদকের একচেটিয়া ব্যবসা করে অঢেল সম্পদ ও শতকোটি টাকার মালিক বনে যান। যুবলীগ দক্ষিণের তৎকালীন সভাপতি সম্রাটকে (কারাবন্দি) কোটি টাকা দিয়ে স্থানীয় যুবলীগের রাজনীতিতে স্বামী হযরতকে জড়িত করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে হযরত নিহত হয়। স্বামীর মৃত্যুর পর নিজের জামাতা মনিরুল ইসলাম রবিনকে নিয়ে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট গড়ে পুনরায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নেন।

রহিমার মাদক ব্যবসায় বিভিন্ন স্পটে অন্তত ৮০ জন যুক্ত রয়েছেন। চক্রটির বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা সম্ভব হলেও রহিমা বরাবরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাগালের বাইরে থেকে গেছেন। এ ব্যাপারে অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (খিলগাঁও জোন) মোহাম্মদ নূরুল আমীন বলেন, রহিমাকে ধরার জন্য বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালানো হয়েছে। ‘তিনি অন্তত ৮০টি মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করেন। একটি নম্বর বেশি দিন ব্যবহার করেন না। এ কারণেই তাকে গ্রেফতার করা কঠিন, তবে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। রহিমার ক্যাশিয়ার বনশ্রী কাজীবাড়ির মাদক ব্যবসায়ী জশিমকে রহিমার অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে জমা দেওয়া একটি আবেদনপত্র দেখিয়ে বলেন, ‘দেখুন আমার খালা শাশুড়িকে প্রধানমন্ত্রী সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন আর তিনি তাঁর জায়গাতেই আছেন।’

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক প্রচার, অভিযান ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করার পরও কীভাবে দিনের পর দিন একজন নারী সকলের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় তা সত্যিই এক আশ্চর্যের বিষয়। আশা করা যায়, অতিশীঘ্র তাকে গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হবে৷

About Ibrahim Hassan

Check Also

দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়া সেই ‘ওসি হেলাল’ সম্পর্কে যা বললেন রনি

সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনিকে হোয়াটসঅ্যাপে ফোন কলের মাধ্যমে ‘ওসি হেলাল’ পরিচয়ে দেখে নেওয়ার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *