খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন খাদ্য অধিদপ্তরের একটি প্রকল্পে বিদেশ যেতে চান ৩০ জন কর্মকর্তা। বৈদেশিক প্রশিক্ষণের নামে এ খাতে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। যেখানে প্রত্যেকের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৯ লাখ টাকা।
সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ সফরের জন্য সবসময় মরিয়া থাকেন এক শ্রেণির কর্মকর্তা। এই লক্ষ্য়ে যেকোনো প্রকল্প প্রস্তাব প্রস্তুত করার সময়ই সর্বপ্রথম বিদেশ সফর ও গাড়ি কেনার ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। বিনা প্রয়োজনে সাধারণ বিষয়েও বিদেশ সফরের প্রস্তাব খাড়া করা হয়। বিষয়টি নিয়ে নানা বিতর্ক শেষ না হতেই এবার সামনে এলো খাদ্য়মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পে বিদেশ সফরের প্রস্তাব।
‘দেশের বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে নতুন খাদ্য গুদাম ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পে এমন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে এই ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন। মঙ্গলবার অনুষ্ঠেয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এ বিষয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে হবে সংশ্লিষ্টদের। এমনটিই জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র।
উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশ সফরের বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এর আগে যুগান্তরকে বলেন, ‘অপচয় কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। অর্থ অপচয়ের একটি অন্যতম উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে উন্নয়ন প্রকল্প। একান্ত প্রয়োজন না হলে প্রশিক্ষণ বা শিক্ষা সফরের নামে পিকনিক করার জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ রাখাটাকে সমর্থন করি না। এ বিষয়ে আমরা সচেতন আছি। আরও তৎপর হতে হবে।’
সূত্র জানায়, ‘দেশের বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে নতুন খাদ্য গুদাম ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ’ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭৯২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। সরকারি অর্থায়নে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রকল্পটি দেশের ৮ বিভাগের ৫৩টি জেলার ১২৮ উপজেলা এবং চারটি সিটি করপোরেশনে বাস্তবায়িত হবে। এর আওতায় ১৯৬টি খাদ্য গুদাম নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেলে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে খাদ্য অধিদপ্তর।
প্রকল্পের আওতায় ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৪০ জনকে স্থানীয় প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। এছাড়া ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩০ জনের বৈদেশিক প্রশিক্ষণের সংস্থান রাখা হয়েছে। তবে পিইসি সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে, প্রশিক্ষণের যৌক্তিকতাসহ এর বিস্তারিত বিভাজনের বিষয়ে সভায় আলোচনা যেতে পারে।
সেই সঙ্গে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে রাজস্ব খাতে সুপারভিশন কনাসালট্যান্টের জন্য ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব রয়েছে। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশন সূত্র মনে করে, এভাবে গড়পড়তা কোনো ব্যয় বা বরাদ্দ অনুমোদন করা সমীচীন হবে না। এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে যতটুকু বা যা প্রয়োজন, সেটিই অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হবে। পাশাপাশি পরামর্শক ব্যয় যৌক্তিকভাবে কমানো প্রয়োজন। পরামর্শকের বিস্তারিত ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) যুক্ত করতেও বলা হবে পিইসি সভায়।
কথা হয় খাদ্য অধিদপ্তরের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিটের নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) আবু বকর সিদ্দিকীর সঙ্গে। শনিবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রকল্প প্রস্তাবে অনেক কিছুই থাকে। মিটিংয়ে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। তারপরই কথা বলা যাবে। এখন বলে কি হবে? তবে গুদামগুলোতে অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হবে। এসব বিষয়ে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। আমরা প্রস্তাব দিয়েছি কর্তৃপক্ষ (পরিকল্পনা কমিশন) যদি মনে করে রাখার দরকার নেই, তাহলে আমরাও বাদ দেব।’
প্রকল্প প্রস্তাবে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম একটি জনবহুল ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিপূর্ণ একটি দেশ। প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের এ দেশ। বিপুল এ জনগোষ্ঠীকে পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ ও তাদের পুষ্টি নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। এ উদ্দেশ্যে সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সংগ্রহ কার্যক্রমের আওতায় খাদ্যশস্য (ধান, চাল, গম) সংগ্রহ করে। এসব খাদ্য বিভিন্ন খাদ্য গুদাম যেমন-এলএসডি (লোকাল সাপ্লাই ডিপো), সিএসডি (সেন্ট্রাল সাপ্লাই ডিপো) ও সাইলোতে (বৃহৎ খাদ্য সংরক্ষণাগার) সংরক্ষণ ও বিতরণ করা হয়।
বর্তমানে খাদ্য বিভাগের অধীন ৬টি সাইলো, ১২টি সিএসডি এবং ৬৩৫টি এলএসডি আছে। এসবের মোট ধারণক্ষমতা ২১ দশমিক ৮০ লাখ টন। পর্যায়ক্রমে ২০২৫ সালের মধ্যে এ ধারণক্ষমতা ৩৭ লাখ টনে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এছাড়া প্রতি বছর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে বিদ্যমান গুদামগুলো খাদ্যশস্য সংরক্ষণের উপযোগী করা হয়। পাশাপাশি প্রকল্প প্রণয়নের মাধ্যমেও দেশের বিভিন্ন এলাকায় খাদ্যগুদাম নির্মাণ করা হয়।
জরাজীর্ণ গুদাম অপসারণ করে নতুন গুদাম নির্মাণ করা গেলে স্বল্প ব্যয়ে খাদ্যশস্য সংরক্ষণের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা যাবে। প্রয়োজনে গুদাম ভাড়া দিয়ে সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়ানো সম্ভব। এসব বিবেচনায় প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ১ দশমিক ৩৫ লাখ টন ধারণ ক্ষমতার গুদাম নির্মাণ করা হবে।
প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় ১৯৬টি খাদ্য গুদাম নির্মাণ এবং ৭২৫টি সিসি ক্যামেরা স্থাপনের মাধ্যমে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। এছাড়া ৩৫ হাজার ৮৫০টি খাদ্যশস্য সংরক্ষণের জন্য ডানেজ (এক ধরনের যন্ত্র) সংগ্রহ করা, ৫০টি ময়েশ্চার স্টাবিলাইজার স্থাপন, কর্মকর্তাদের জন্য ১০টি যানবাহন ক্রয় এবং জনবল নিয়োগ করা হবে।
উল্লেখ্য়, কিছুদিন পূর্বেই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঘি-মাখন তৈরি শিখতে বিদেশ যেতে ৭৫ লাখ টাকার আবদার জানিয়েছিলো বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড।