মশা নিধনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে সাড়ে তিন কোটি টাকা খরচ করে পাকিস্তান থেকে ৩৭ বছর আগে আমদানি করা হয়েছিল ৫০০ মেট্রিক টন ডাইক্লোরো ডাফেনাইল ট্রাইক্লোরেথেন (ডিডিটি) পাউডার। কিন্তু মানবদেহ, জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হওয়ায় বিষাক্ত এই রাসায়নিক আমদানির চার বছর পরই নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে বিপুল পরিমাণ এই রাসায়নিকের কিছু ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে নষ্ট হলেও প্রায় ৪৮০ মেট্রিক টন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে গুদামে। তিন দশক চেষ্টার পর সেগুলো জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ফ্রান্সে নিয়ে ধ্বংসের ব্যবস্থা চূড়ান্ত হয়েছে। তবে রাসায়নিকগুলো ধ্বংসে ব্যয় হচ্ছে ৭০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ সরকার ডিডিটি পরিবেশসম্মতভাবে অপসারণের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পের নাম পেস্টিসাইট রিস্ক রিডাকশন ইন বাংলাদেশ। পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক ফরিদ আহমেদ প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন।
জানা গেছে, ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী মশা নিধনের জন্য ১৯৮৫ সালে পাকিস্তান থেকে ৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ৫০০ মেট্রিক টন ডিডিটি আমদানি করা হয়েছিল। ১৯৮৯ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও নিষিদ্ধ হয় এই রাসায়নিক। কিন্তু ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সময় গুদাম প্লাবিত হয়ে কিছু রাসায়নিক ভেসে যায়।
প্রকল্প পরিচালক ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘৫০০ মেট্রিক টনের মতো আমদানি করা হয়েছিল। সেগুলো নিষিদ্ধের পর গুদামেই ছিল। কিন্তু ৯১ সালে জলোচ্ছ্বাস হয়। ওই সময় কিছু ভেসে গেছে অথবা বিভিন্নভাবে কিছু রাসায়নিক চলে গেছে। বাকিটা আমরা এখন ধ্বংসের প্রক্রিয়া শুরু করেছি।’
অবশিষ্ট ডিডিটি বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদে সরকারি সাব মেডিকেল ডিপোতে চারটি আলাদা-আলাদা গুদামে রাখা আছে। সেগুলো অপসারণের কাজে সহযোগিতা দিচ্ছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। ডিডিটিগুলো গুদাম থেকে বের করার আগে মেডিকেল ডিপোর সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ইতোমধ্যে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। পুরো ডিপোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে জাতিসংঘের ওই সংস্থা।
ফ্রান্সে নেয়ার উদ্দেশে ডিডিটিগুলো প্যাকেটজাত করার প্রাক-প্রক্রিয়া বুধবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) থেকে শুরু হয়েছে। এফএও’র প্রতিনিধি দলের তত্ত্বাবধানে একদল প্রশিক্ষিত কর্মী প্যাকেটজাত করার আগে প্রাথমিক কাজগুলো সেরে নিচ্ছেন। গুদাম প্রাঙ্গনে মোটা পলিথিন দিয়ে বানানো হয়েছে একাধিক অস্থায়ী ঘর। বিদেশ থেকে আনা যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চারটি আলাদা আলাদা গুদাম থেকে সব ডিডিটি প্রথমে এনে এক জায়গায় রাখা হবে। তারপর সেগুলো দ্বিস্তরবিশিষ্ট আলাদা-আলাদা প্যাকেটে নেওয়া হবে। এরপর গুদামের ভেতরে নেওয়া হবে কনটেইনার। গুদাম থেকে ডিডিটিভর্তি কনটেইনার সরাসরি যাবে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজে।
ফরিদ আহমেদ জানান, সাত দিনের মধ্যে ডিডিটি প্যাকেটজাতের কাজ শুরুর চেষ্টা করবেন তারা। এপ্রিলের মধ্যে সব ডিডিটি প্যাকেটজাত করে কনটেইনারে তোলার কাজ তারা শেষ করতে চান। এরপর ধাপে ধাপে কয়েকটি জাহাজে করে ডিডিটিগুলো পাঠানো হবে ফ্রান্সে। ডিডিটি কনটেইনারে তোলার পর সব গুদাম, সাব মেডিকেল ডিপোর সব অফিস, স্থাপনাসহ পুরো প্রাঙ্গন পানি দিয়ে ধোয়া হবে। ধোয়ার পর সেই পানিও ডিডিটির সঙ্গে পাঠানো হবে ফ্রান্সে।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ১২টি দেশের বন্দরের ওপর দিয়ে যাবে ডিডিটিবাহী জাহাজ। এসব বন্দর কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন আছে। ফরিদ আহমেদ জানিয়েছেন, ১১টি দেশের বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে অনুমোদন দিয়েছে। একটি দেশের অনুমোদনের বিষয়ে যোগাযোগ চলছে।
ডিডিটি অপসারণ কাজের জন্য ফায়ার কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী ও শ্রমিকদের এফএও’র তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ১০ শ্রমিকের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। এফএও’র প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, জনস্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের কোনো ধরনের ক্ষতিসাধন না করে বিপজ্জনক জৈব রাসায়নিক পেস্টিসাইট অপসারণের লক্ষ্যে তারা কাজ করছেন।
এর আগে, গত ১১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে এ সংক্রান্ত একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে এফএও, স্বাস্থ্য, পুলিশ, কৃষি, কাস্টমস, বন্দর, সিটি করপোরশনসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। সভায় এফএও’র কর্মকর্তা মার্ক ডেবিস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পেস্টিসাইট অপসারণের উদাহরণ দিয়ে নিরাপত্তার ওপর সর্বোচ্চ জোর দেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য রসায়নবিদ অধ্যাপক বেণু কুমার দে বলেন, ‘ডিডিটি মানবদেহের জন্য শুধু নয়, গাছপালা, জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ সবকিছুর জন্যই ক্ষতিকর। এটা খুবই বিষাক্ত রাসায়নিক। মানবদেহের লিভার এবং কিডনিকে সরাসরি আক্রমণ করে। এক সময় আমাদের দেশে শুটকিতে পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য ডিডিটি ব্যবহার করা হতো। মানবদেহে ক্ষতি বিবেচনায় পরবর্তী সময়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ডে চট্টগ্রাম কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজে ডিডিটি উৎপাদন হতো। বাংলাদেশে নিষিদ্ধের পর সেখানেও ডিডিটি উৎপাদন বন্ধ করা হয়।’
গুদাম থেকে কনটেইনারে তোলা এবং চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে জাহাজীকরণের সময় সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে এই রসায়নবিদ বলেন, ‘ডিডিটিগুলো যেন কোনোভাবে উন্মুক্ত কোনো স্থানে না পড়ে, পরিবেশের সঙ্গে না মেশে, বিশেষ করে পানির সঙ্গে যাতে মিশতে না পারে সেদিকে সর্বোচ্চ লক্ষ্য রাখতে হবে।’
এফএও’র প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ডিডিটি অপসারণ থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে নেওয়ার সময় পর্যন্ত আশাপাশের এলাকায় চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে।
এদিকে ডিডিটি অপসারণসহ সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের মোট বাজেট ধরা হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। জাতিসংঘের সংস্থা গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ) পুরো অর্থায়ন করছে।
প্রকল্প পরিচালক ফরিদ আহমদ বলেন, ‘পুরো প্রকল্পের বাজেট ৭০ কোটি টাকা। প্রকল্পের মধ্যে দেশের পরিবেশ অধিদফতর, স্বাস্থ্য অধিদফতর, মৎস্য অধিদফতর ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ল্যাবের গবেষণা ও ঝুঁকি হ্রাসকরণ সংক্রান্ত সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয় আছে। সুতরাং সেখানে একটা অংশ খরচ হবে। ডিডিটি অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় সভা-কর্মশালা, প্রশিক্ষণ, ১৩ জন কনসালট্যান্টের বেতন-ভাতা সংক্রান্ত আনুষাঙ্গিক কাজেও কিছু ব্যয় হবে। এরপর ৩০ শতাংশের মতো অর্থ খরচ হবে ডিডিটি অপসারণ করে ফ্রান্সে নিয়ে ধ্বংস করার মূল কাজে। ফ্রান্স ছাড়া এই বিপজ্জনক রাসায়নিক ধ্বংস আর তেমন কোনো দেশ করে না। বাজেট এবং টেন্ডারও এফএও করেছে। এখানে আমাদের কাজ শুধু তাদের দাফতরিক সহযোগিতা দেওয়া।’
প্রসঙ্গত, সরকার, সিটি কর্পোরেশন ও অন্যান্য মাধ্যমে মশক নিধনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ ব্যবস্হা গৃহীত হলেও আশানুরূপ ফল পাওয়া এখনও সম্ভব হয়নি।