পরিকল্পনা কমিশন (Planning Commission) দেশের বিভিন্ন প্রকল্পের তদারকি করে থাকে। প্রতিবছরেরই দেশের বিভিন্ন প্রকল্পের কার্য সঠিক ভাবে পরিচালনার জন্য সরকারি কর্মকর্তা বিদেশ সফরে যেয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সরকারের মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়। তবে অনেক সময় এই সফর নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এবং এই সফরের খরচ নিয়ে নানা ধরনের অনিয়ম সংঘঠিত হচ্ছে। এবার ঘি-মাখন তৈরি শিখতে বিদেশ যেতে ৭৫ লাখ টাকার আবদার বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড। এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত উঠে এলো প্রকাশ্যে।
বাংলাদেশ ডেইরি কোঅপারেটিভ ইউনিয়ন লিমিটেড (মিল্কভিটা) (MilkVita) কীভাবে দুগ্ধজাত পণ্য তৈরি করতে হয় তা শিখতে বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য অস্বাভাবিক খরচ আবদার করেছে। মূল প্রকল্পে ৩০ লাখ টাকা নেওয়া হলেও সংশোধিত প্রস্তাবিত প্রকল্পে তা বাড়িয়ে ৭৫ লাখ টাকা করা হয়। প্রশিক্ষণ খাতে ব্যয় বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পায়নি পরিকল্পনা কমিশন। এই ব্যয়কে অস্বাভাবিক বিবেচনা করে প্রশিক্ষণের জন্য ২০ লাখ টাকা রাখার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। বৃহত্তর ফরিদপুর ও আশপাশের চর এলাকায় গবাদি পশুর জাত উন্নয়ন এবং দুধের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি কারখানা স্থাপনের প্রকল্পে এ প্রস্তাব করা হয়েছে। গত ২৬ জানুয়ারি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মো. মামুন-আল-রশিদের (Mamun-al-Rashid) সভাপতিত্বে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মিল্কভিটার দাবিকৃত অতিরিক্ত বিদেশী প্রশিক্ষণের খরচও কমানো হয়েছে। মূল প্রকল্পে কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য ৩ মিলিয়ন টাকা নেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পে তা বাড়িয়ে ৭৫ লাখ টাকা করা হয়। তবে কমিশন সেই অনুরোধে রাজি হয়নি। করোনা সংকট বিবেচনায় কমিশন প্রকল্পের আওতায় কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিতে রাজি হয়েছে। নতুন প্রস্তাবে কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণে ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ের কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাননি তারা।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামোর সদস্য (সচিব) মো. মামুন-আল-রশিদ বলেন, আমরা জানি মিল্কভিটা সমবায়ের মাধ্যমে দুধ উৎপাদন করে। এর জন্য ৭৫ লাখ টাকা খরচ করে কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা দেখি না। এখানে সরকারি কোষাগার থেকে ৭৫ লাখ টাকা খরচ করতে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তা ৭৫ লাখ থেকে কমিয়ে ২০ লাখ করা হয়েছে। কিভাবে উন্নত মানের দুগ্ধজাত পণ্য তৈরি করা যায় তার প্রযুক্তি দেখার জন্য আমি ২০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছি। ইন্টারনেট দেখে প্রকল্পের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। একইসঙ্গে ইন্টারনেট থেকে তথ্য সরিয়ে কারিগরি কমিটির মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পে হিমায়িত ঘর, কোল্ড রুম এবং প্যাকেজিং এবং ঘি, মাখন ও পনির উৎপাদন বিভাগের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিল্কভিটার একজন প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইন্টারনেট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এসব খাতের দর নির্ধারণ করা হয়েছে। পিইসি বৈঠকে একটি কমিটির মাধ্যমে ফ্রিজিং রুম, হিমাগার ও প্যাকেজিং এবং ঘি, মাখন ও পনির উৎপাদন বিভাগের আনুমানিক ব্যয় নির্ধারণ করে নতুন প্রকল্প সংযোজনের বিষয়ে সম্মত হয়।
প্রকল্পে ইউএইচটি (UHT) (হাই টেম্পারেচার) মিল্ক প্ল্যান্ট সেক্টরের মূল্য নির্ধারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে মিল্কভিটা প্রতিনিধি বলেন, ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) এ এই খাতের মূল্যও যুক্ত করা হয়েছে। বিশদ আলোচনার পর, পিএইচ সভা একটি কমিটির মাধ্যমে ইউএইচটি মিল্ক প্ল্যান্টের মূল্য নির্ধারণ এবং রেফারেন্স সহ নতুন প্রস্তাবিত প্রকল্পে যুক্ত করার বিষয়ে সম্মত হয়। মামুন-আল-রশিদ বলেন, দেশে অনেক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয় না। ফলে ইন্টারনেট দেখে একটি মূল্য নির্ধারণ করা হয়। বিশ্বাসযোগ্য অনেক সাইট আছে। তবে, এটি চূড়ান্ত নয়, শুধুমাত্র অনুমান। এরপরও একটি কমিটি গঠন করে ব্যয়ের হিসাব করতে বলা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, শুধু বিদেশ ভ্রমণ নয়, অন্যান্য খরচ ও সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রধান কারখানা ফরিদপুর সদর থেকে মাদারীপুরের টেকেরহাটে স্থানান্তরের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভায় মাদারীপুরে মিল্কভিটার নিজস্ব জমিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ফরিদপুর সদরে অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবিত জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয় ২৮ কোটি টাকা, যা নতুন জায়গায় সংরক্ষণ করা হবে।
প্রকল্প সংশোধনী প্রস্তাবে প্রজনন ষাঁড় কেনার জন্য ১.৫ কোটি টাকার বিধান রেখে একটি নতুন খাত যুক্ত করার বিষয়ে জানতে চাইলে মিল্কভিটা জানায় যে গরুর জাত উন্নয়নের জন্য অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা থেকে পাঁচটি ষাঁড় (ষাঁড়) আনতে হবে। ব্রিডিং ষাঁড় কেনার ব্যয় একটি কমিটি দ্বারা নির্ধারিত হবে এবং প্রকল্পে যোগ করা হবে। এই প্রকল্পের ভবন নির্মাণ খাতে একক ও পরিমাণের কোনো উল্লেখ নেই। ফলে কমিশনের অভিমত, কারখানা, অফিসার ও স্টাফ কোয়ার্টার, অফিস ভবন, ষাঁড়ের শেড, ডেইরি কুলিং সেন্টার এবং মিনি ডেইরি প্ল্যান্টের ইউনিট ও পরিমাণ উল্লেখ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ ডেইরি কো-অপারেটিভ ইউনিয়ন লিমিটেডের অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (সংঘ ও পরিকল্পনা) মো. মুস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, কিছু কর্মকর্তা বিদেশে গিয়ে উন্নতমানের দুগ্ধজাত পণ্য তৈরি ও গরুর জাত উন্নয়ন করবেন। এসব কারণে বিদেশি প্রশিক্ষণে ব্যয় করার প্রস্তাব করা হয়। তবে তা কমিয়ে ২০ লাখ টাকা করা হয়েছে। বিদেশ থেকে কিছু ফর্মুলেশন আনা হবে। বড় গরুর জাত উন্নয়নও প্রয়োজন। এ জন্য বিদেশে প্রশিক্ষণে বাড়তি খরচ করতে হয়েছে।
৩৪৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা ব্যয়ে মূল প্রকল্পটি ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত বাস্তবায়নের জন্য একনেক (ECNEC) সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ঢাকা ও খুলনা বিভাগের ১০টি জেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হল দুগ্ধ কারখানা স্থাপন এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে আয়বর্ধক কার্যক্রম ও সুযোগ সৃষ্টি করা। বাস্তবায়ন পর্যায়ে কিছু নতুন খাতে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এটিকে ভাসিয়ে রাখার জন্য প্রকল্পটি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা। ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমবর্ধমান ব্যয় হল টাকা। ৭১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা এবং প্রকৃত অগ্রগতি ২০ দশমিক ৮২ শতাংশ। প্রকল্পটি ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ সহ ২০২১-২২ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে চলমান বিনিয়োগ প্রকল্পের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে বিলম্ব এবং করোনা পরিস্থিতি পরিবর্তিত হওয়ায় প্রকল্পের অগ্রগতি আশানুরূপ হয়নি। এ কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আরও একটু সময় প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। নানা কারণে দেশে প্রতি বছরই দুধের ঘাটতি দেখা দেয়। এ কারণে সরকার চার হাজার কোটি টাকার গুঁড়ো দুধ আমদানি করে। নিজস্ব উৎপাদনে দুধের ঘাটতি মেটাতে বড় পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে ফরিদপুরের আশপাশের এলাকায় ‘হাব’ নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। ফরিদপুরে বিশাল ইউএইচটি মিল্ক প্ল্যান্ট, স্বয়ংক্রিয় আইসক্রিম প্ল্যান্ট, চকলেট এবং ক্যান্ডি প্ল্যান্ট থাকবে। পাস্তুরিট মিল্ক প্ল্যান্ট, ঘি, রসমালাই, মিস্টিদাই, লাবাং, মাখন, পনির উৎপাদনও থাকবে। ফ্লেভার মিল্ক প্রসেসিং প্ল্যান্ট, কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র, মাইক্রো-বায়োলজিক্যাল ল্যাবরেটরি, ডেইরি বায়োটেকনোলজিক্যাল ল্যাবরেটরি এবং মোবাইল ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হবে।
প্রকল্পের উন্নয়নের নামে বিদেশ সফর করতে গিয়ে প্রতিবছর সরকারের বিপুল পরিমানের অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এবং সরকারি খাতায় এই খরচের পরিমান দেখানো হচ্ছে বিশাল অঙ্কের। এক্ষেত্রে এই অনিয়ম প্রতিরোধে বেশ সোচ্চার হয়েছে সরকার। এমনকি এই বিষয় সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রের জন্য দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। ইতিমধ্যে এরই লক্ষ্যে কাজ করছে দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিরা।