টেকনাফের (Teknaf) বরখাস্ত ওসি প্রদীপকে (OC Pradeep) নিয়ে দেশে জুড়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। তিনি মূলত সিনহা হত্যা মামলার পর থেকে আলোচনা-সমালোচনার শীর্ষে উঠে এসেছেন। এমনকি প্রকাশ্যে উঠে এসেছে তার সকল অনিয়মের অপরাধ কর্মকান্ড গুলো। তিনি সরকারি পোশাকের আড়ালে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের অনিয়ম কর্মকান্ড পরিচালানা করেছেন। এবং গড়েছেন বিপুল পরিমান সম্পদ। তিনি সিনহা হত্যা ঘটনার প্রধান আসামী। আজ এই নির্মম ঘটনার রায় প্রকাশ করবে আদালত।
বহুল আলোচিত মেজর (অব.) সিনহা (Major Sinha) হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আজ সোমবার (৩১ জানুয়ারি)। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে সিনহা নিহত হন। দীর্ঘ শুনানি, সাক্ষীর বক্তব্য, জেরা এবং আইনজীবীদের যুক্তিতর্কের পর বিচারক রায়ের তারিখ ধার্য করেন। সিনহা হত্যা মামলার প্রধান আসামি বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাসসহ ১৫ আসামির শাস্তি কি হবে তা নিয়ে মানুষের মনে কৌতূহল তৈরি হয়েছে। টেকনাফ থানার ওসি থাকাকালে প্রদীপের হাতে নির্যাতিত নিহত সিনহার পরিবারসহ শত শত পরিবার এ মামলার রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মো. চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা করবেন ইসমাইল। সিনহা হত্যা মামলার চার্জশিটে টেকনাফ মডেল থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাসের বিভিন্ন অপকর্মের তালিকা রয়েছে। এ মামলার আসামি ও সাক্ষীদের বক্তব্যেও হত্যার দিন তার নিষ্ঠুর আচরণের বিবরণ পাওয়া যায়। চার্জশিটে ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে উঠে আসা ৭টি ভয়ঙ্কর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে
১. প্রদীপের ক্রসফায়ার বাণিজ্য
সিনহা হত্যা মামলার দ্বিতীয় আসামি প্রদীপ কুমার দাস ২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর কক্সবাজার জেলার মহেশখালী থানা থেকে টেকনাফ মডেল থানায় যোগদান করেন। সিনহা হত্যা মামলার অভিযোগপত্র অনুযায়ী ওসি প্রদীপ দায়িত্ব নিয়ে ক্রসফায়ার বাণিজ্যে নামেন। মাদক নির্মূলের আড়ালে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে মোটা অংকের টাকা কামানোর নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন। অভিযোগপত্রে তার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিবরণ মিলেছে। মাদক উদ্ধারের ঘটনা ঘটলে বা মাদকদ্রব্য নিয়ে টার্গেট তৈরি করা হলে (একটি উপযুক্ত ক্ষেত্রে), অভিযুক্ত বা ব্যক্তিকে প্রথমে গ্রেফতার করা হবে। তারপর নিজের উৎসের টাকা আদায়ের জন্য আদালতে যেতেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, ভিকটিমকে ক্রসফায়ারে না দেওয়ার জন্য পরিবারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হয়। দাবি অনুযায়ী টাকা না পেলে ক্রসফায়ারে নিহত ও তার স্বজনদের মামলায় আসামি করা হবে। তার নেশা ও পেশা ছিল আসামিদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা এবং তাদের বাড়িতে আগুন দেওয়া, তাদের সম্পত্তি উচ্ছেদ করা এবং অবৈধভাবে লাখ লাখ টাকা আদায় করা। এটি করার জন্য, তিনি তার সমমনা পুলিশ সদস্যদের দ্বারা নিজস্ব একটি ক্ষুদ্র ও সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করেন। (অভিযোগপত্র থেকে পাঠ-ক, পৃষ্ঠা-১১)
২. কু-কর্মের বিষয়ে সদা সতর্ক
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, প্রদীপ কুমার দাস অপকর্মের খবর সংগ্রহ ও প্রচার না করার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা প্রদীপের এই স্পর্শকাতর অংশ স্পর্শ করেছিলেন। র্যাবের রিমান্ড শেষে আদালতে দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি পরিদর্শক লিয়াকত আলী চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন। ঘটনার কয়েকদিন আগে থেকে এলাকায় ডাকাতদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় একটি দল ছবি তোলার নামে অন্য কাজে এলাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যদি দলটি এটিকে সুবিধাজনক মনে করে তবে তাদের এটি শেষ করতে হবে। (অভিযোগ-বি, পৃষ্ঠা-18 থেকে পাঠ)
৩. সিনহা পানি চান; ওসি প্রদীপ গলায় পাড়া দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করেন
মেজর সিনহার গায়ে চার রাউন্ড গুলি চালানোর পর ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী ওসি প্রদীপকে ফোন করেন। আহত সিনহাকে হাসপাতালে না পাঠানোর কথা জানান তিনি। ওসি প্রদীপ কুমার দাস ৩০ মিনিটের মধ্যে শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে আসেন। পরে ওই দিন চেকপোস্টে দায়িত্বরত এপিবিএন সদস্য এসআই শাহজাহানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বর্বরতার বর্ণনা পাওয়া যায়। ওসি প্রদীপ স্যার আসার পর ইন্সপেক্টর লিয়াকত ও নন্দদুলালের সাথে একান্তে কথা বলেন। কথা শেষে ফোর্স নিয়ে রাস্তায় শুয়ে থাকা মেজর (অব.) সিনহার কাছে এসে ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলেন, কুকুরটাকে অনেক টার্গেট করে শেষ করতে পারি। প্রদীপ স্যার মেজর (অব.) সিনহা বেঁচে আছেন কি নেই। মেজর সিনহা যখন হাহাকার করছিল এবং জল চাইছিল, প্রদীপ স্যারকে লাথি মেরে তিরস্কার করে মেরে ফেলে। (অভিযোগ থেকে পাঠ – পৃষ্ঠা-17, অনুচ্ছেদ-3)
৪. মেজর সিনহা নড়াচড়া করছে কি না ৩ বার জানতে চান প্রদীপ
ঘটনার প্রায় দেড় ঘণ্টা পর মেজর সিনহাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের এএসআই লিটন মিয়াকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। হাসপাতালে পৌঁছানো পর্যন্ত ওসি প্রদীপের কাছ থেকে ৩টি কল আসে। এএসআই লিটন মীর তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, “আমি হাসপাতালে যাওয়ার পথে ওসি প্রদীপ স্যারের সাথে তিনবার কথা বলেছি। তিনি আমাদের অবস্থান জানতে চান এবং মেজর সাহেব সরে যাচ্ছেন কি না। (অভিযোগ পৃষ্ঠা-18)
৫. সিফাতকে ওয়াটার থেরাপি দেন প্রদীপ
সিনহার সহকর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শী শাহেদুল ইসলাম সিফাত জানান, ওসি প্রদীপ তাকে নির্যাতনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওসি প্রদীপ আমাকে চেকপোস্টের ভেতরে নিয়ে এসে মারধর করে এবং ‘শালে পানি ঢালো’ বলে চিৎকার করে। (অভিযোগ পৃষ্ঠা-18)
৬. পরিকল্পনা হয় জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে
জুলাই মাসের শেষ দিনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা। তবে পুলিশ সূত্রে ও মামলার আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানা যায়, ওই মাসের মাঝামাঝি থেকে সিনহাকে বাগে পেতে মুখিয়েছিলেন ওসি প্রদীপ। নুরুল আমিন (Nurul Amin) স্বীকার করেন, জুলাই মাসের মাঝামাঝি ওসি প্রদীপ স্যার আমাদের আইসি লিয়াকত স্যারের মাধ্যমে টেকনাফ থানায় ডেকে পাঠান। নিজাম উদ্দিন ও আমি থানায় গেলে ওসি প্রদীপ স্যার ও আইসি লিয়াকত স্যারের সঙ্গে দেখা করি। ওসি প্রদীপ স্যার বলেন, সিনহা টিনহা এসব ঝামেলা রাখতে পারবেন না। তাদের অদৃশ্য হতে হবে। ‘ (অভিযোগ পৃষ্ঠা-18)
৭. সেনা সদস্যকে তাড়িয়ে দেন ওসি প্রদীপ
শামলাপুর চেকপোস্টে ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন রামু সেনার (Ramu Sena) এএসইউ সার্জেন্ট নিবাস মোহাম্মদ। আইয়ুব আলী। তিনি মেজর সিনহাকে চিনতে পারেন। তিনি তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নিয়ে নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার ছবি তুলতে গেলে ওসি প্রদীপের নির্দেশে পুলিশ তার মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে তাকে ধাওয়া দেয়। পরে সেনাবাহিনীর লে. মুনতাসির আরিফকে নিয়ে বাহারছড়া থানায় যান সার্জেন্ট আইয়ুব। ওসি প্রদীপও তাকে চলে যেতে বলেন। তিনি ফোনে বলেছিলেন যে তিনি সেনাবাহিনীতে কাজ করতে পারবেন না।
টেকনাফের ভুক্তভোগীদের অভিযোগ
প্রদীপ কুমার দাস টেকনাফ ওসি থাকাকালে মাদক নির্মূলের নামে ২২ মাসে ১৪৪টি বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে। এতে ২০৪ জনের মৃত্যু হয়। নিহতদের সবাইকে মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারের ব্যাজ দেওয়া হয়। তবে সাধারণ মানুষ বলছেন, ক্রসফায়ারে নিহতদের অধিকাংশই নিরীহ মানুষ।
পুলিশের কাজ জনগনের জান মালের নিরাপত্তা প্রদান করা। তবে এই বাহিনীতে কিছু অসাধু ব্যক্তি রয়েছে যাদের অনিয়মের জের ধরে পুরো বাহিনী নানা ভাবে প্রশ্ন বিদ্ধ হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন শ্রেনীর বিভিন্ন পেশার মানুষের কাছে। তবে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে জন গন বান্ধব করে গড়ে তুলতে হাতে নিয়েছেন নানা ধরনের পদক্ষেপ। ইতিমধ্যে দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিরা সরকারের নির্দেশান অনুযায়ী কাজ শুরু করেছেন।