স্বাধীনতা-উত্তর প্রথমবারের মত আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্য়ে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমোদিত অনুসন্ধান কমিটির কাছে নাম প্রস্তাবের জন্য় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০১৭ সালে সর্বশেষ গঠিত নির্বাচন কমিশনের ন্য়ায় এবারও সমমনা দলগুলোকে মাধ্য়ম হিসেবে ব্য়বহারের চিন্তা করছে।
আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের শরিকদের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্রগুলো বলছে, জোটের শরিক কোনো কোনো দলের শীর্ষ দু-একজন নেতাকে ফোন দিয়ে ঢাকায় থাকার অনুরোধ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কিছু ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গেও সরকারের যোগাযোগ রয়েছে।
আজ মঙ্গলবার বিকেলে গণভবনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠক ডাকা হয়েছে। এই বৈঠকে ইসি গঠনে অনুসন্ধান কমিটির কাছে কীভাবে, কাদের নাম প্রস্তাব করা হবে—তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে দলের নেতারা জানিয়েছেন।
এর আগে ২০১৭ সালে কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন গঠনের আগেও এই কৌশল নেওয়া হয়েছিল। তখন অনুসন্ধান কমিটির কাছে সিইসিসহ ও তিনজন কমিশনারের নামের প্রস্তাব এসেছিল ১৪ দলের শরিকদের কাছ থেকে।
এবার বিএনপিসহ সাতটি দল ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতির সংলাপ বর্জন করেছে। বিএনপি অনুসন্ধান কমিটিতে নাম প্রস্তাব করবে না বলে জানিয়েছে। আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, বিএনপির মতো আরও কিছু দল নাম প্রস্তাব না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
অবশ্য আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, অনুসন্ধান কমিটিতে তাঁর দল নাম জমা দেবে। কাদের নাম জমা দেওয়া হবে, সেটি এখনো আলোচনা হয়নি। তবে যোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নাম জমা দেওয়া হবে। অন্য দলগুলো কাদের নাম প্রস্তাব করছে, সেটা নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
এবারও নির্বাচন কমিশন গঠনে আমলাদের গুরুত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। একজন সাবেক সেনা ও একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার থাকার বিষয়ে আলোচনা আছে। এবার সিইসি পদের জন্য একজন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও এক সাবেক মুখ্য সচিবের নামও প্রাথমিক বিবেচনায় আছে বলে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে, ২০১৭ সালে নির্বাচন কমিশন (বর্তমান কমিশন) গঠনের জন্য অনুসন্ধান কমিটির কাছে নামের তালিকা দেওয়ার আগে ১৪ দলের শরিক ও সমমনা দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করেছিল আওয়ামী লীগ। ১৪ দলের তৎকালীন সমন্বয়ক মোহাম্মদ নাসিম (প্রয়াত) শরিক দলগুলোকে তাদের তালিকায় নির্দিষ্ট কিছু নাম রাখার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। এমনকি তখন জাতীয় পার্টির সঙ্গেও সরকারের যোগাযোগ হয়েছিল। সেবার শরিক ও সমমনা দলগুলো পাঁচটি করে নামের তালিকা দিয়েছিল, সেসব তালিকায় আওয়ামী লীগের পছন্দের এক–দুজনের নাম যুক্ত করা হয়েছিল। এ কারণে সিইসি কে এম নূরুল হুদাসহ কোনো কোনো কমিশনারের নাম একাধিক দলের তালিকায় ছিল।
সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, ২০১৭ সালে অন্তত চারটি দল সিইসি হিসেবে কে এম নূরুল হুদার নাম প্রস্তাব করেছিল। দলগুলো হচ্ছে জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাপ ও তরীকত ফেডারেশন। কমিশনার রফিকুল ইসলামের নাম প্রস্তাব করেছিল পাঁচটি দল—জাতীয় পার্টি (জাপা), জাসদ, সাম্যবাদী দল, তরীকত ফেডারেশন ও জাতীয় পার্টি (জেপি)। কবিতা খানমের নাম প্রস্তাব করেছিল আওয়ামী লীগ, সাম্যবাদী দল, ন্যাপ ও গণতন্ত্রী পার্টি। শাহাদৎ হোসেন চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করেছিল সাম্যবাদী দল ও গণতন্ত্রী পার্টি। এর বাইরে মাহবুব তালুকদারের নাম প্রস্তাব করেছিল বিএনপি।
আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, পছন্দের ব্যক্তিদের একাধিক দলের তালিকা রাখা গেলে তাদের নিয়োগ দেওয়া সহজ হবে। গতবারের মতো এবারও একই পদ্ধতি মানা হবে। তবে কেউ যাতে প্রস্তাব করা নাম আগে থেকে প্রকাশ না করে, সে বিষয়ে অনুরোধ জানানো হবে।
এ বিষয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘নাম দেওয়ার বিষয়ে তাঁদের দলে আলোচনা হবে। ১৪–দলীয় জোটে এ বিষয়ে আলোচনা হয়নি।
অবশ্য ১৪–দলীয় জোটের শরিক একটি দলের শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করে জানান, তাঁদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে। অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করে নাম প্রস্তাব করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।’
আইন না থাকলেও ২০১৭ সালে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। এবার ইসি গঠনে আইন হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের একাধিক সূত্র বলছে, আগেরবারের প্রক্রিয়া ও এবারের প্রক্রিয়ার মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য থাকার সম্ভাবনা নেই। যেসব নাম বেশি বেশি দলের তালিকায় থাকবে, অনুসন্ধান কমিটি সেগুলো থেকেই সংক্ষিপ্ত তালিকা করতে পারে। চূড়ান্ত নিয়োগের আগে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতি এই কাজে প্রধানমন্ত্রীর মতামত নেবেন। ফলে দুই দফায় ক্ষমতাসীনদের পছন্দ-অপছন্দ যাচাইয়ের সুযোগ থাকছে।
এদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) সহ কমিশনের অন্য়ান্য় সদস্য় গঠনের লক্ষ্য় অনুসন্ধান কমিটি ইতিমধ্য়েই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নাম আহ্বান করেছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দল ১০ ফেব্রুয়ারীর মধ্য় সর্বোচ্চ ১০ টি নাম প্রস্তাব করতে পারবে। বিএনপির মত রাজনৈতিক দলের নাম প্রস্তাবের সিদ্ধান্ত বর্জন করায় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) দেওয়া নাম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তাদের তালিকা থেকে একজন কমিশনার নিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা আছে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির দেওয়া নামের তালিকা কেমন হতে পারে, সেটা বোঝার চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ। অবস্থা বুঝে তাদের এ বিষয়ে অনানুষ্ঠানিক পরামর্শও দেওয়া হতে পারে।