রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের প্রায় ১৮ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় প্রায় তিনবছর কারাভোগ করেছেন পাটকল শ্রমিক জাহালম। তিনি ছাড়াও জালিয়াতির এসব মামলায় আবু সালেকসহ আরও একজনের নামও এসেছে, তিনি গোলাম মতুর্জা।

আরো পড়ুন

Error: No articles to display

সালেকের ব্যাংক হিসাবের ৩৩টি চেকের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক থেকে এই বিপুল পরিমাণ টাকা লুট হয়েছে বলে তদন্তে পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ অর্থ জমা হয়েছে ’মেহেরুন ছামাদ ট্রেডার্স’র প্রোপাইটার গোলাম মর্তুজার ব্যাংক হিসাবে। এসব ঘটনায় করা দুদকের ২৬ মামলায় জাহালম ছাড়াও আসামি আছেন সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর নানা ধাপের কর্মকর্তারাও। তবুও চূড়ান্ত অভিযোগপত্রে গোলাম মর্তুজা ও আবু সালেকের কোনো ’অস্তিত্ব’ পায়নি বলে দাবি করেছে দুদক।

কে এই গোলাম মর্তুজা? চক্রটির অন্যতম সদস্য এই মর্তুজার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এখনও বেশ বহাল তবিয়তেই আছেন তিনি। যদিও তার চক্রের দায়ভার মাথায় নিয়ে কারাভোগ করেছেন জাহালম।

অনুসন্ধান এবং দুদকের নথিপত্র ঘেটে গোলাম মর্তুজার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, গোলাম মর্তুজার বর্তমান আবাস নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা সদরের দক্ষিণপাড়া (পাইলট স্কুলের পূর্ব পাশে) হলেও তার আসল বাড়ি পার্শ্ববর্তী মল্লিকপুর ইউনিয়নের জোগিয়া গ্রামে। এই গ্রামের মধ্যপাড়ার মৃত ছামাদ মোল্লার ছেলে তিনি।

তার বড়ভাই মৃত তবিবুর রহমান রুনু ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আর মতুর্জার তিন সন্তানের মধ্যে দুইজন ছেলে ও একজন মেয়ে। তারা সবাই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে পড়ছেন এবং স্ত্রী কালনা সরকারি প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা।

ঢাকার ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে এখন লোহাগড়াতেই আছেন গোলাম মর্তুজা। জড়িয়েছেন স্থানীয় রাজনীতিতেও। তবে তেমন কোনো পদ-পদবি না থাকলেও মল্লিকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে বেশ ভালোই সময় কাটছে তার। সময় কাটান ফেসবুকেও।

গোলাম মর্তুজার আরো একটি পরিচয় হচ্ছে- তিনি একটি বড় ধরনের জালিয়াতি চক্রের সদস্য। তার প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৩টি চেকে ১৮ কোটি টাকা সোনালী ব্যাংক থেকে লুট হয়েছে। এই চক্রটির অনুসন্ধানের নামে ভুল তদন্তে প্রায় তিনবছর জেল খেটেছেন ঘোড়াশালের একটি পাটকল শ্রমিক টাঙ্গাইলের নাগরপুরের জাহালম। অথচ হাতে আসা নথিপত্রে দেখা গেছে, কোনো মামলার চার্জশিটে জাহালমের নাম-ই নেই।

আবার কোনোটিতে আছে জাহালম ওরফে আবু সালেক ওরফে গোলাম মর্তুজা (৩০)। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, এই তিনজনের বাড়ি তিন জেলায়। বয়সেরও ফারাক রাত আর দিন। কোনো মামলায় আবার জাহালমের বাড়ি টাঙ্গাইল, আবু সালেকের বাড়ি ঠাকুরগাঁও ও গোলাম মর্তুজার বাড়ি নড়াইলে দেখানো হয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের সব মামলার এজাহার, চার্জশিট ও সম্পূরক চার্জশিটে গোলাম মর্তুজা ’মেহেরুন ছামাদ ট্রেডার্সে’র প্রোপাইটার বা স্বত্ত্বাধিকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানায় বলা হয়েছে- গ্রাম: লোহাগড়া (দক্ষিণ পাড়া), নড়াইল।

আবার অন্য একটি মামলার অধিকতর তদন্তে মর্তুজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করেছে দুদক। এছাড়া কোনো কোনো মামলায় মর্তুজার বাড়ি দেখানো হয়েছে, টাঙ্গাইলের নাগরপুরে।

মামলার নথিপত্র, দুদকের এজাহার ও চার্জশিট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আবু সালেক ’মেহেরুন ছামাদ ট্রেডার্সে’র প্রোপাইটার মর্তুজাকে ৩৩টি অ্যাকাউন্ট পে চেক দিয়েছেন। যদিও তার ওই অ্যাকাউন্টে কোনো টাকাই ছিলো না। এরপরও ’চেক বাউন্স’ না হয়ে কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে থাকা গোলাম মর্তুজার মেহেরুন ছামাদ ট্রেডার্স’র হিসাবে ১৮ কোটি টাকা যোগ হয়েছে। পরে এই টাকা তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করেছে চক্রটি।

তবে এসব ঘটনার তদন্তে নেমে আবু সালেককেই জাহালম হিসেবে চিহ্নিত করেন দুদক কর্মকর্তারা। আবু সালেক জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) জালিয়াতির মাধ্যমে জাহালমের ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। ঠিকানা জালিয়াতির এ ঘটনায় তিনবছর কারা ভোগ করেছেন জাহালম।

এ ঘটনায় একটি জাতীয় দৈনিকে ’স্যার, আমি সালেক নই, জাহালম’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বিষয়টি নজরে আসে আদালতের। পরে গত ৩ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ জাহালমকে দায়মুক্তি দিয়ে খালাস দেওয়ার নির্দেশ দেন।

ওইদিন আদালত বলেন, ’কোনো নির্দোষ ব্যক্তিকে এক মিনিটও কারাগারে রাখার পক্ষে আমরা না। এই ভুল তদন্তে কোনো সিন্ডিকেট জড়িত কিনা, সিন্ডিকেট থাকলে কারা এর সঙ্গে জড়িত, তা চিহ্নিত করে আদালতকে জানাতে হবে। না হলে আদালত এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে।’

এ রকম ভুলের দায় দুদক কোনোভাবেই এড়াতে পারে না বলেও মন্তব্য করেছেন আদালত। এক পর্যায়ে বিচারক উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ’এ মামলায় যাকে আসামি করা উচিত ছিল, তাকে আসামি না করে সাক্ষী বানালেন। জজ মিয়া নাটক আরেকটি বানালেন নাকি? দুদক একটি স্বাধীন সংস্থা।’

’বাংলাদেশের জন্য দুদকের মত একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। টিআইবি কী রিপোর্ট দিল সেটা আমাদের কনসার্ন না। কারণ টিআইবিও ভুল করতে পারে। দুদক যদি প্রোপারলি কাজ না করে তাহলে আমাদের যে উন্নয়ন হচ্ছে তার স্থায়িত্ব থাকবে না। দেশ পাকিস্তান হতে বেশি সময় লাগবে না, আমাদের ভিক্ষা করতে বসতে হবে।’

বিচারক বলেন, ’আমরা দুদকের কাজে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। দুদক স্বাধীনভাবে কাজ করুক এটা আমরাও চাই। আগেও আপনাদের (দুদক) ব্যাংকের দুর্নীতি মামলায় সাবধান করেছি। মনে রাখতে হবে এটি একটি স্বাধীন দেশ।’

’অনেক মামলায় দেখেছি, আপনারা কোনো ব্যাক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামার আগেই তাকে নোটিশ দিয়ে দেন। অথচ পরে অনুসন্ধান করে দেখা যায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই নেই। তাহলে কেন নোটিশ দিচ্ছেন? একজন অপরাধী না হওয়ার পরও জেল খাটতে হল কেন? দুদককে স্বচ্ছ হতে হবে।’

এরপর আদালত ওইদিন জাহালমকে দুদকের ২৬ মামলা থেকে অব্যাহতির আদেশ দেন।

এদিকে জাহালমের কারাভোগ ও হয়রানির ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তাদের গাফিলতি আছে কি-না তা খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে দুদক। সংস্থাটির চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ জানান, বিষয়টি তদন্ত করতে জেলা জজ পদমর্যাদায় দুদকের পরিচালক (লিগ্যাল) আবুল হাসনাত মো. আব্দুল ওয়াদুদকে তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে।

এ বিষয়ে দুদক কমিশনার আমিনুল ইসলাম মঙ্গলবার (০৫ ফেব্রুয়ারি) বলেন, জাহালমের অনুসন্ধানে কার গাফেলতি তা ২০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে কমিটিকে বলা হয়েছে।

এদিকে চক্রটির পেছনে আরও রাঘব বোয়াল থাকতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, তাদের চাপেই দুদক গোলাম মর্তুজাকে বাদ দিয়ে জাহালমকে ফাঁসিয়েছে।
-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর

News Page Below Ad

আরো পড়ুন

Error: No articles to display