আওয়ামীলীগ-বিএনপির (Awami League-BNP) মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাকে ঘিরে চলছে বেশ আলোচনা-সমালচোনা। এরই সূত্র ধরে লবিষ্ট নিয়োগ নিয়ে একে অন্যের সঙ্গে তর্ক-বির্তকে জড়িয়ে পড়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া নিষেধাজ্ঞা নিয়ে অনেকেই অনেক ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এবং এই বিষয়ে সরকারের কর্মকান্ড নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং বর্তমান সরকারের প্রসঙ্গ তুলে বেশ কিছু কথা বললেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারুফ মল্লিক।
সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা (ministers-MPs) গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা কিছু হালকা কথাবার্তা ও বিএনপির ওপর লবিংয়ের দায় চাপিয়ে পার করতে চাইছেন। তাদের আচরণ খুব বুদ্ধিমান এবং উপযুক্ত বলে মনে হয় না। প্রথমত, তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। এখন বিএনপির বিরুদ্ধে লবিংয়ের (lobbying) অভিযোগ এনে মাঠ গরম করার চেষ্টা করছেন। এমন নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়া মন্ত্রী-এমপিরা বুঝতে পারছেন না বলেই মনে হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞার গুরুত্ব ও গভীরতা বুঝতে ব্যর্থতা তাদের রাজনৈতিক অপরিপক্কতার বহিঃপ্রকাশ। নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার পর সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। প্রথমে সরকারের মন্ত্রীরা নির্লজ্জভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেন। তিনি প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা সামনে আনেন। সহযোগীরাও এ বিষয়ে তথ্য দিতে থাকেন। কয়েকদিন ধরে তারা আজেবাজে কথা বলতে থাকে। তবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়ায় ড্রোন হামলায় আট লাখের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে তা তারা জানায়নি। যুক্তরাষ্ট্রকে যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করতে হয়, তবে তাকে অবশ্যই বেসামরিক নাগরিকদের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। কিন্তু আমাদের সরকারের লোকেরা এ ব্যাপারে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। কারণ, তারাও এই তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের সুবিধাভোগী। যুক্তরাষ্ট্রকে কেউ মানবাধিকারের পরম বন্ধু মনে করে না। যেমন, আমাদের দেশে কেউ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে বিশ্বাস করে না। বিশ্বজুড়ে শান্তি ও মানবাধিকারের জন্য যুক্তরাষ্ট্র যা করে বা করতে চায় তা তার নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্ডার অংশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা হিসাবে যা শুরু হয়েছিল তা আরও ভয়াবহ। এত বছর পর নিখোঁজদের স্বজনদের কাছ থেকে মুচলেকা নিতে শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন। স্বজনদের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ করা হয়েছে। বোকামির একটা সীমা আছে। পরিস্থিতিতে বোঝা যাচ্ছে, নিষেধাজ্ঞার পর বিভ্রান্তিতে এসব করা হচ্ছে।
যদি আইন প্রয়োগকারীরা মনে করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (United State) তাদের বন্ড পর্যবেক্ষণ করছে না, তবে এটি একটি বড় ভুল হবে। তারা যদি মনে করে যে সরকার এই বন্ডগুলো জাতিসংঘ (United Nation) বা যুক্তরাষ্ট্রে জমা দেবে এবং নিজেকে নিরাপদসূত্র হিসেবে প্রমাণ করবে, তাহলে তা হবে সরকারের জন্য চরম বোকামি। এটা বরং বিপদ বাড়িয়ে দেবে; কিছুই কমবে না। র্যাব সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে আরেকটি কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাস দমনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না যে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ তার উপযোগিতা হারিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন নীতি তৈরি করছে। জঙ্গিবাদ দমনের নামে বেসামরিক মানুষ হত্যার জন্য র্যাবের বিরুদ্ধে আলাদা অভিযোগও দায়ের করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে। এসব বিবেচনায় সরকারকে কথা বলে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। নিষেধাজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের প্রতি ঘা হিসেবে সরকারের তদবিরের কিছু তথ্য গণমাধ্যমে ফাঁস হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার মানবাধিকার গোষ্ঠীর গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ মোকাবেলা করার জন্য লবিস্ট নিয়োগ করেছে। এর জন্য সরকারের ব্যয় হয়েছে ২.৪ মিলিয়ন ডলার। সরকারি লবিতে নিয়োগ নিয়ে এর আগেও খবর প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য এসব সংগঠন লবিস্টের চেয়ে জনসংযোগ বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সরকারের বিরুদ্ধে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ধামাচাপা দিতে লবিস্ট নিয়োগের অভিযোগও রয়েছে বিএনপির বিরুদ্ধে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সম্প্রতি সংসদে বলেছেন, বিএনপি লবিংয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ২ মিলিয়ন টাকা দিয়েছে। তিনি ওই টাকাকে অবৈধ ও কালো টাকা বলে উল্লেখ করে বলেন, তার কাছে অর্থপ্রদানের প্রমাণ রয়েছে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কিন্তু পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হয়তো খেয়াল করেননি যে তিনি কাঁচের ঘরে বসে বিএনপির দিকে ঢিল ছুড়ছেন। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগও ২০০৪ ও ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট কোম্পানি নিয়োগ করেছিল। মনে হয় সরকারের মন্ত্রীরা এসব জানেন না বা ভুলে গেছেন।
শুধু আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নয়, বিদেশে তদবির করার অধিকার যে কারও আছে। বৈধভাবে টাকা পাঠালেও তদবিরে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। মন্ত্রীরা বিএনপির আয়-ব্যয়ের হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, বিএনপি তদবির করার টাকা পেল কোথায়? লবির নিয়োগ নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া আর্থিক বিবরণীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না বলে মন্তব্য করেন তিনি। তাদের টাকা কোথায় কিভাবে খরচ করবে সেটা বিএনপির নিজস্ব বিষয়। বিএনপি সম্পর্কে তাদের বক্তব্য যৌক্তিক। কিন্তু বিএনপির লবি নিয়োগের অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে ২০০৪ ও ২০০৫ সালে আওয়ামী লীগের লবি নিয়োগের অর্থের উৎস সম্পর্কেও তথ্য প্রকাশ করতে হবে। বিএনপিকে প্রশ্ন করার আগে অবস্থান ড. আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েরই লবি নিয়োগের তথ্য প্রকাশ্যে আনা দরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কীভাবে সরকারী অর্থায়নে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছিল সে সম্পর্কে আরও প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা দরকার। লবিস্ট নিয়োগের বিষয়টি কি সংসদে আলোচিত হয়েছিল? জানতাম না। তাহলে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ অস্বীকার করার জন্য জনগণের টাকায় কীভাবে এবং কী প্রক্রিয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তা জনগণকে জানাতে হবে। এটা সরকারি অর্থের অপচয় মাত্র। এ ব্যাপারে সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে।
হালকা ও হালকা কথা বলে আত্মতৃপ্তি উপভোগ করা যায়। কিন্তু এর পরিণতি ভালো নয়। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে র্যাব-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ১২টি মানবাধিকার গোষ্ঠী জাতিসংঘে চিঠি দিয়েছে। এই মানবাধিকার সংস্থাগুলির পরিচয় এবং নামগুলির দিকে নজর দিলে আপনাকে একটি ভাল ধারণা দেবে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আমেরিকা ও ব্রিটেনের লোকজন দ্বারা পরিচালিত হয়। তারা অ্যাংলো-আমেরিকান পররাষ্ট্র নীতির অগ্রগামী। ১২টি মানবাধিকার সংস্থার চিঠি জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের টেবিলে অনন্তকাল ধরে রাখা হবে তা ভাবার কোন কারণ নেই। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নও গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে ধীরে ধীরে সক্রিয় হয়ে উঠছে। সরকারের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের বোঝা উচিত, বাংলাদেশের মতো একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিরাট পার্থক্য রয়েছে। দেশের রাজনীতিতে কারসাজি করা যায়, বিএনপিকে (BNP) চাপে রেখে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে রাজনীতিবিদদের লাল দেখানো যায়। বাজে কথা বলে চরিত্রকে হত্যার চেষ্টা করা যেতে পারে; কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ এখনো ছোট মাছ। কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে যা ইচ্ছা তাই বলা যায় না। সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তারা এখনো পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন না। সাহস থাকলে ভালো হয়। কিন্তু সাহস দেখানোর জন্য, পরচর্চা করা এবং অভিনয় করা উপযুক্ত নয়। এতে বইয়ের ঝুঁকি কমে না।
অবশ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে অভিযোগ তুলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা অস্বীকার করেছে বাংলাদেশ সরকার। এবং সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তবে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহরের জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহন করেছেন বাংলাদেশ সরকার। এমনকি এই বিষয়ে কাজ করার জন্য ৩ মন্ত্রীর প্রতি বিশেষ দায়িত্ব প্রদান করেছেন।