জুলাইয়ে সংঘটিত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলীয় এক সমাবেশে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, সামনে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অত্যন্ত কঠিন হবে। তিনি সবাইকে সতর্ক করে দেন যে, বিএনপি ইতোমধ্যেই ক্ষমতায় চলে এসেছে—এমন ভুল ধারণা দলকে মারাত্মক ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে। তাই তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সবাইকে দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি ও যেকোনো ধরনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকার কঠোর নির্দেশনা দেন তিনি।
দলের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে তারেক রহমান স্পষ্ট হুঁশিয়ারি দেন যে, বিএনপির ইমেজ ক্ষুণ্ণ হয়—এমন কোনো আচরণ সহ্য করা হবে না। তবুও, তার নির্দেশনার পরও দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু নেতাকর্মী বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, কিছু প্রভাবশালী স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতা মনোনয়ন রাজনীতির অংশ হিসেবে এসব বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িতদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন, যার ফলে দলের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে দলীয় হাইকমান্ড বিভিন্ন বিশেষ টিম গঠন করে এসব নেতাকর্মীর তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, তারেক রহমান কোনোভাবেই বিতর্কিত কাউকে জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন দেবেন না। দলের নেতারা জানিয়েছেন, যেসব নেতাকর্মী তার নির্দেশনা অমান্য করে দলের ইমেজ ক্ষুণ্ণ করছেন, তাদের প্রতি জিরো টলারেন্স নীতি নেওয়া হয়েছে—তারা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত মূল দল ও অঙ্গসংগঠনের মোট ৩,২২৩ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মূল দলের ১,৮০০ জন নেতাকর্মীর মধ্যে ৮০০ জনকে বহিষ্কার, ৫০ জনের পদ স্থগিত, ৭০০ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ, ১০০ জনকে সতর্ক এবং ১৫০ জনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, ছাত্রদল থেকে ৪০০ জন বহিষ্কৃত, ৬০০ জনকে কারণ দর্শানো নোটিশ; স্বেচ্ছাসেবক দল থেকে ১০০ জন বহিষ্কৃত, ১৫০ জনকে নোটিশ; এবং যুবদলের ২০০-এর অধিক নেতাকর্মী বহিষ্কৃত হয়েছেন।
সূত্র বলছে, ২০০১, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে যাঁরা অংশ নিয়েছেন এবং বর্তমানে যাঁরা মনোনয়ন প্রত্যাশী, তাঁদের অবস্থানও মূল্যায়নের আওতায় আনা হচ্ছে। বিএনপি এবার মনোনয়ন চূড়ান্ত করবে কয়েকটি মূলনীতির ভিত্তিতে—বিশ্বস্ততা, সততা এবং জনসমর্থন।
মনোনয়ন নির্ধারণে তিনটি মূল যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে ত্যাগ,পরীক্ষিত সততা,এলাকায় পরিচিত ও জনপ্রিয় ব্যক্তি হওয়া।
দলের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র এ মানদণ্ড নিশ্চিত করেছে।
এবারের নির্বাচনে তুলনামূলক তরুণ প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হতে পারে বলেও জানা গেছে। তরুণ ও অভিজ্ঞদের মধ্যে ভারসাম্য রেখে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। তবে কোনোভাবেই চাঁদাবাজ বা বিতর্কিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেওয়া হবে না।
গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর থেকেই বিএনপির হাইকমান্ড নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের উদ্যোগে গোপনে মাঠপর্যায়ে সার্ভে পরিচালনা করা হয়েছে। আরও কয়েকটি সংগঠনের মাধ্যমে পৃথক জরিপ কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। গত মার্চে একটি আন্তর্জাতিক অরাজনৈতিক সংস্থা সারাদেশে লক্ষাধিক মানুষের ওপর জরিপ চালিয়েছে।
জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, সংগঠনিক শাস্তি প্রত্যাহার বা পুনর্বিবেচনার জন্য প্রায় ১,৫০০ আবেদন জমা পড়েছে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, এর মধ্যে প্রায় ২০০ জন অভিযুক্তদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। স্থানীয় নেতারাও কেন্দ্রীয় দপ্তরে লিখিতভাবে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এখন পর্যন্ত তদন্তে প্রমাণ না মেলা নেতার হার ১৩ শতাংশ।
তারেক রহমানের বিশ্বস্ত সহযোগীদের নেতৃত্বে একটি নির্বাচন-ভিত্তিক ডেটাবেজ সেল গঠন করা হয়েছে। সেখানে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ব্যক্তিগত ইতিহাস, জনপ্রিয়তা, দলে ও কর্মীদের সমর্থন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর শক্তি ও দুর্বলতা বিশ্লেষণসহ নানা তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, “আমরা প্রায় ৫ হাজার নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছি, প্রয়োজনে আরও ৫ হাজার করব। বিএনপি জিয়াউর রহমানের আদর্শেই চলবে। চাঁদাবাজ, বিতর্কিত, কিংবা তাদের প্রমোটকারী কেউই মনোনয়ন পাবে না।”
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “দলের স্বচ্ছ ইমেজ রক্ষায় আমরা জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করব। যাঁরা দোষী প্রমাণিত হবেন, তাঁদের মনোনয়ন দেওয়া হবে না। তবে নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাদের শাস্তি প্রত্যাহার করা হবে।”
রাজশাহী বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলিম জনকণ্ঠকে বলেন, “তারেক রহমান দলীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণকারীদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁদের মনোনয়ন দেওয়া হবে না।”
তিনি বলেন, “বিএনপি মানুষের ভালোবাসার দল। শহীদ জিয়ার আদর্শে পরিচালিত হয়। চাঁদাবাজি, দখল, বিতর্কিত কার্যকলাপে বিএনপি জড়াবে না, কাউকে প্রমোট করবে না।” দলের সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে শতাধিক ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হয়েছে। তবে এদের কেউ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়ালে তাদেরও মনোনয়ন বাতিল হবে।
জানা গেছে, তারেক রহমান সম্ভাব্য প্রার্থীদের ভিডিও কলে যুক্ত হয়ে নিজ নিজ এলাকায় সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। যাচাই-বাছাই শেষে পর্যায়ক্রমে ৩০০ জনকে চূড়ান্ত গ্রিন সিগন্যাল দেওয়া হবে। পাশাপাশি সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি সব পর্যায়ে নির্বাচনী কারচুপি, কেন্দ্র দখল, ভোট ডাকাতি, ফল পরিবর্তনসহ যেকোনো ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর বিরুদ্ধে প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। একই সঙ্গে জনগণের আরও কাছাকাছি যাওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন।
তারেক রহমান বলেন, “জনগণই বিএনপির শক্তি। তাই জনগণের পাশে থাকতে হবে, তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে।” তিনি নির্দেশনায় আরও বলেন, “সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের কোনো দল নেই। এদেরকে আইনের হাতে তুলে দিতে হবে, যেই দলেরই হোক না কেন।”
দল ও অঙ্গসংগঠনের সকল ইউনিট ও কমিটির নেতাদের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে কঠোরভাবে। তিনি বলেন, “বিএনপি শতভাগ একটি গণতান্ত্রিক দল। আওয়ামী লীগের মতো ফ্যাসিজমে বিশ্বাস করে না। কোনো কমিটির কেউ যদি অনিয়মে জড়ায়, তার দায় সংশ্লিষ্ট নেতাকেই নিতে হবে।”
নির্বাচনী সেলের একজন সদস্য জানান, “যারা বিগত আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন, মামলা-হামলার শিকার হয়েও দলের প্রতি অনুগত ছিলেন, তরুণ এবং পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি রয়েছে, তাদের এবার অগ্রাধিকার দেওয়া হতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “ক্ষমতায় গেলেও কেউ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়ালে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চাঁদাবাজি, দখল, জনগণের ক্ষতির মতো যেকোনো কাজ করলে—even if powerful—they will be handed over to law enforcement if necessary.”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “আমরা এমন একটি রাষ্ট্র চাই, যেখানে জনগণ শাসন করবে, কেউ কারও উপর জুলুম করবে না। বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে যদি দলের কেউ বিতর্কিত কাজ করে, তাহলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
জেলার নেতারাও ‘ক্লিন ক্যান্ডিডেট’ নীতিকে সমর্থন দিয়েছেন। পঞ্চগড় জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ফরহাদ হোসেন আজাদ বলেন, “আমরা অনিয়ম পেলেই তদন্ত করি, শোকজ করি, বহিষ্কারও করি। আগামি নির্বাচনে আমরা পরিচ্ছন্ন প্রার্থীদের মনোনয়ন চাই।”
ভোলা জেলা বিএনপির সদস্য সচিব রাইসুল আলম বলেন, “শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন সৎ ও পরিচ্ছন্ন রাষ্ট্রনায়ক। তার আদর্শেই আমরা রাজনীতি করি। তৃণমূল থেকে আমাদের দাবি—ক্লিন ইমেজের প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া হোক।”



