ঢাকার পুরান শহর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে পাথর দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে মো. সোহাগকে (৩৯)। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে নতুন করে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে, কারণ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে উঠে এসেছে চকবাজার থানা যুবদলের নেতা মাহমুদুল হাসান মহিনের নাম। হত্যার পর ‘প্রতিবাদী জনতা’ সেজে নাটকীয়ভাবে স্লোগান দেওয়ার সময় সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ে যান তিনি।
হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে নিজেই ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে যান মহিন। ‘চাঁদাবাজের ঠাঁই নাই’, ‘আওয়ামী দোসরদের বিচার চাই’—এমন নানা স্লোগান দিতে দেখা যায় তাকে। উদ্দেশ্য ছিল, খুনের পরপরই একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের নাটক তৈরি করা, যাতে হত্যাকে আড়াল করে জনরোষকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া যায়। কিন্তু নাটকের পর্দা নামতে সময় লাগে মাত্র ১০ মিনিট। এ সময়ের মধ্যেই পুলিশ একজন চৌকস কর্মকর্তার তৎপরতায় শনাক্ত করে ফেলে মহিনকে। এরপর পুলিশের কড়া অবস্থানে আটক হন তিনি।
পুলিশ জানায়, ঘটনাস্থলের আশেপাশে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখেই নিশ্চিত হওয়া যায় যে, মহিন শুধু পরিকল্পনাকারীই নন, হত্যাকাণ্ডের সময়ও ছিলেন এবং পুরো পরিস্থিতি কিভাবে জনমনে প্রভাব ফেলবে, তা নিয়েও সরাসরি কাজ করছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনাও সিসিটিভির সঙ্গে মিলে যায়। গ্রেপ্তারের সময় মহিনের অনুসারীরা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত পুলিশের কড়া নজরদারিতে তাকে আটকে ফেলা সম্ভব হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, এটি কোনো তাৎক্ষণিক রাগের বহিঃপ্রকাশ ছিল না। বরং পূর্বপরিকল্পিতভাবে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার এবং প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। হত্যার পরেই মহিন পরিস্থিতি নিজের পক্ষে নেওয়ার চেষ্টা করেন, যা পুরো ঘটনায় তার সরাসরি জড়িত থাকার প্রমাণ বহন করে।
স্থানীয় সূত্র এবং পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, চকবাজার থানা যুবদলের সদস্য সচিব পদপ্রার্থী মহিন এবং ছাত্রদল কর্মী অপু দাস মিলে এলাকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই হত্যায় যুক্ত হন। ভিডিও প্রকাশের পরই তাদের সাজানো পুরো চিত্রনাট্য ভেঙে পড়ে।
এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত একাধিক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন রাজীব বেপারি ও সজীব বেপারি নামের দুই ভাই। সোমবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাসুম মিয়া তাদের পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। শুনানিতে রাজীব জানান, তার কোনো আইনজীবী নেই এবং তিনি নির্দোষ। সজীব কোনো মন্তব্য করেননি।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে আরও রয়েছেন তারেক রহমান রবিন। এর আগেই অস্ত্র মামলায় তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। রবিন ১২ জুলাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। এছাড়া আলমগীর ও লম্বা মনির নামের আরও দুই আসামিকেও চারদিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে।
গ্রেপ্তার রাজীব ও সজীবের পরিবার দাবি করছে, তারা প্রকৃত আসামি নন। পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, রাজীব ও সজীব একটি পরিবহন সংস্থার গাড়ি চালাতেন মাত্র। মালিকের নাম রাজীব ও সজীব হওয়ায় নামের মিল থেকে পুলিশ ভুল করে চালকদের গ্রেপ্তার করেছে বলে অভিযোগ তাদের স্বজনদের। দুই ভাইয়ের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায়।
ঘটনায় রাজনৈতিক ছায়া আরও ঘনীভূত হয় যখন বিএনপি-ঘনিষ্ঠ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, তারা এই মামলায় আসামিদের পক্ষে কোনো আইনি সহায়তা দেবে না। সোমবার ঢাকা আইনজীবী সমিতিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ফোরামের আহ্বায়ক খোরশেদ আলম এই সিদ্ধান্ত জানান। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ কেন্দ্রীয় নেতারা।
মহিনের পরিকল্পিত নাটক দ্রুত ভেঙে পড়লেও ঘটনাটি রাজনৈতিক, সামাজিক এবং নিরাপত্তাগতভাবে বেশ জটিল বার্তা দিচ্ছে। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে দিনের আলোয় এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং এরপর ‘প্রতিবাদী নাটক’ সাজানোর চেষ্টা জনমনে উদ্বেগ তৈরি করেছে। এটি শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয়, বরং একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের আভাস বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

