চীন নেমেছে মাঠে, তিস্তা নিয়ে ভারতের দাদাগিরি শেষ হবে এবার? (ভিডিও সহ)

বাংলাদেশ ভাটির দেশ হওয়ায়, হিমালয় থেকে প্রবাহিত নদীগুলো এদেশের বুক চিরে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী থাকলেও, উজানের দেশ হিসেবে ভারত বহু নদীতে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের পানির ন্যায্য অধিকার ব্যাহত করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের এসব কার্যক্রম জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের পানি কনভেনশনের পাঁচ ও সাত নম্বর অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

১৯৭৫ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গজল ডোবায় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে তিস্তা নদীর নিয়ন্ত্রণ নেয় ভারত। ফলে বাংলাদেশ পর্যাপ্ত পানির অভাবে ভুগতে থাকে এবং দিন দিন মরুকরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে, যা নদীর ১১৫ কিলোমিটার এলাকাকে সুরক্ষিত রাখতে সহায়তা করবে। তবে, বাংলাদেশের এ উদ্যোগ ভালোভাবে নেয়নি ভারত। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে তিস্তা নদীর ওপর একটি বৃহৎ ব্যারেজ নির্মাণে চীনের আগ্রহ থাকলেও, ভারতের আপত্তির কারণে প্রকল্পটি থমকে আছে।

এতদিন ভারত বাংলাদেশের ওপর কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করলেও, সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি বদলেছে। সম্প্রতি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভারতের প্রভাব উপেক্ষা করে চীনের সহায়তায় তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছে। ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন জানিয়েছেন, চীন প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রস্তুত, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাংলাদেশকেই। বিশ্লেষকদের মতে, এটি বাস্তবায়িত হলে তিস্তা নিয়ে ভারতের আধিপত্যের অবসান ঘটতে পারে।

তবে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, চীনের এ আগ্রহ শুধুমাত্র সহযোগিতামূলক নয়, বরং কৌশলগতও। তিস্তা প্রকল্পকে চীন তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করছে। বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডরের মাধ্যমে চীন তাদের ইউনান প্রদেশকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করতে চায়, যেখানে তিস্তা প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ভারত বরাবরের মতোই তিস্তা প্রকল্পে চীনের ভূমিকার বিরোধিতা করছে এবং এটিকে তাদের ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে দেখছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের এই প্রকল্পে যুক্ত হওয়ার পেছনে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সুবিধাও রয়েছে। চীন ইতোমধ্যে লাওস, পর্তুগাল, কাজাকস্থান, আর্জেন্টিনা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বাঁধ নির্মাণে বিনিয়োগ করেছে, যা তাদের অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।

তিস্তা প্রকল্পের আওতায় নদীর দুই পাড়ে ২২০ কিলোমিটার গাইড বাঁধ নির্মাণ, নদী খনন, ভাঙন প্রতিরোধ, আধুনিক সেচ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ পর্যটন কেন্দ্র, মাছ চাষ ও অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা রয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রায় ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি বাংলাদেশের জন্য ভূকৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ হয়ে উঠতে পারে, যা কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের জন্য একটি ট্রাম্প কার্ড হিসেবে কাজ করবে।


বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত হলো

সীমান্তে অপরাধমূলক ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যৌথ টহল জোরদার করা, তাৎক্ষণিক ও পূর্বাভাসমূলক গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ভারতের নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত ৫৫তম বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলন শেষে এক যৌথ প্রেস বিবৃতিতে এই সিদ্ধান্তগুলোর কথা জানানো হয়।

শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাতে বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম জানান, সম্মেলনে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল অংশ নেন। অন্যদিকে, বিএসএফ মহাপরিচালক শ্রী দলজিৎ সিং চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের ভারতীয় প্রতিনিধিদল সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

বিজিবি মহাপরিচালক সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হতাহতের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং এ ধরনের ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিএসএফের প্রতি আহ্বান জানান।
সম্মেলনে যেসব বিষয়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও বিএসএফ একমত হয়েছে, সেগুলো হলো—

১. সীমান্তে নিরস্ত্র নাগরিকদের ওপর গুলি চালানো, হত্যা, আহত বা মারধরের ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে সীমান্তের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যৌথ টহল বৃদ্ধি, উভয় দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী উপকৃত হবে, এমন তাৎক্ষণিক এবং আগাম গোয়েন্দা তথ্য একে অপরের মধ্যে আদান-প্রদান, সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসরত জনসাধারণের মধ্যে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ, বিভিন্ন ধরনের আর্থসামাজিক ও উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ এবং সীমান্তে যেকোনো হত্যা সংঘটিত হলে তার যথাযথ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

২. আলোচনায় সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে কোনো স্থাপনা, কাঁটাতারের বেড়া, প্রতিরক্ষায় ব্যবহৃত হয়, এমন কোনো স্থাপনা বা বাংকার নির্মাণের ক্ষেত্রে উভয় দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ পরিদর্শক দলের পরিদর্শন এবং যৌথ আলোচনার দলিলের ভিত্তিতে নির্মাণের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ ছাড়া সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে বন্ধ থাকা অন্যান্য উন্নয়নমূলক কাজের ব্যাপারে যথোপযুক্ত পর্যায়ে জয়েন্ট ভেরিফিকেশনের (যৌথ যাচাই) মাধ্যমে দ্রুত সমাধান করা হবে।

৩. বিভিন্ন ধরনের আন্তসীমান্ত অপরাধ দমন, বিশেষ করে ফেনসিডিল, ইয়াবা, গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য ও গবাদিপশু পাচার রোধ, অবৈধ অনুপ্রবেশ, মানব পাচার, স্বর্ণ, অস্ত্র, জাল মুদ্রার নোট প্রভৃতি চোরাচালান রোধ এবং এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সম্পর্কে তাৎক্ষণিক তথ্য আদান-প্রদান করা হবে।

৪. আন্তর্জাতিক সীমানা আইন লঙ্ঘন করে উভয় দেশের নাগরিক ও বাহিনীর সদস্যদের অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের ফলে সৃষ্ট ভুল–বোঝাবুঝি ও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে সীমান্তে উভয় বাহিনীর নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি দুই দেশের সীমান্তবর্তী জনসাধারণকে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করা থেকে বিরত রাখতে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।

৫. মানব পাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, বিশেষ করে মানব পাচারের মতো অমানবিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত উভয় দেশের অপরাধী বা দালালচক্রের কার্যক্রম প্রতিরোধে পরস্পরকে সহায়তা এবং মানব পাচারের শিকার ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্ট দেশের প্রচলিত দেশের আইন অনুযায়ী উদ্ধার ও পুনর্বাসন করা হবে।

৬. উভয় পক্ষ ‘সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার’ আওতায় পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধির জন্য গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নে উভয় বাহিনীর পারস্পরিক সহযোগিতার প্রশংসা করেন। উভয় পক্ষ আগামী দিনে যৌথ খেলাধুলা, জয়েন্ট রিট্রিট সেরিমনিসহ বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে।

৬. এ ছাড়া আগরতলা থেকে আখাউড়ার দিকে প্রবাহিত সীমান্তবর্তী চারটি খালের বর্জ্য পানি অপসারণে উপযুক্ত পানি শোধনাগার স্থাপন, জকিগঞ্জের কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে রহিমপুর খালের মুখ উন্মুক্তকরণ, আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সম্ভাব্য অবস্থান এবং তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।