Monday , December 16 2024
Breaking News
Home / Countrywide / বাংলাদেশীদের যেভাবে গুম করতো ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা

বাংলাদেশীদের যেভাবে গুম করতো ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা

গুমের ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী আতঙ্কের নাম। সম্প্রতি প্রকাশিত গুম কমিশনের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন থেকে উঠে এসেছে ভয়াবহ চিত্র। এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার পরিকল্পিত অপারেশন, নির্যাতন এবং হত্যা কৌশলের বিবরণ। বিশেষত, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।

গুম কমিশনের তথ্যমতে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) বাংলাদেশে এক হাজার ৬৭৬টি গুমের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে ৭৫৮টি ঘটনার তদন্ত করা হয়েছে। ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ১৩০টি গুমের অভিযোগ নথিভুক্ত হলেও ২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত ২১টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে।

প্রতিবেদনে গুমের ঘটনা চিহ্নিত করতে চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে— ভিকটিমের স্বাধীনতা হরণ, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা, ভিকটিমের অবস্থান সম্পর্কে পরিবারের অজানা থাকা, ভিকটিমকে কোনো আইনি সুরক্ষা না দেওয়া। এ ছাড়া, গুমের ঘটনা পাঁচটি ধাপে সংঘটিত হয়েছে: অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা এবং লাশ গুম।

গুমের ঘটনার পেছনে দুটি প্রধান পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথমত, ভিকটিমকে আটক করে নির্যাতনের মাধ্যমে অন্যদের তথ্য আদায় করা। দ্বিতীয়ত, প্রভাবশালী নেতার সরাসরি নির্দেশে অভিযান পরিচালনা।

গুমের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও ছিল সুপরিকল্পিত। মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ভিকটিমের অবস্থান চিহ্নিত করে অপহরণ করা হতো। তদন্তে জানা যায়, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই)-এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) এই নজরদারি পরিচালনা করত।

আটকের পর ভিকটিমদের ওপর চালানো নির্যাতনের বিবরণ শিউরে ওঠার মতো। এক যুবককে কোনো ব্যথানাশক ওষুধ ছাড়াই ঠোঁট সেলাই করে দেওয়া হয়। এক ব্যক্তিকে যৌনাঙ্গে এবং কানে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। ভিকটিমদের সাউন্ডপ্রুফ কক্ষে নির্যাতন করা হতো। কিছু কারাগার এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যেখানে নির্যাতনের জন্য বিশেষ যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছিল।

এক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, তাকে গুলি করে হত্যার আগে শারীরিকভাবে এতটাই অক্ষম করে দেওয়া হয়েছিল যে তার পক্ষে পালানো সম্ভব ছিল না। আরেকজনকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পালানোর চেষ্টা করার পর গুলি করে হত্যা করা হয়।

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে আটটি গোপন কারাগারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব কারাগারে ভিকটিমদের নির্যাতন ও আটক রাখা হতো। এসব কারাগার পরিচালনায় ডিজিএফআই, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব), এবং কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)-এর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আটক ভিকটিমদের বেশিরভাগ সময়ই রাতে অপহরণ করা হতো। তাদের চোখ বাঁধা এবং হাতকড়া পরানো হতো। ভিকটিমদের দ্রুততার সাথে এমনভাবে অপহরণ করা হতো যাতে কেউ কিছু বুঝতে না পারে।

গুমের শিকার বেশিরভাগ ভিকটিমেরই পরিণতি ছিল ভয়াবহ। অনেককে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হতো। বুড়িগঙ্গা এবং শীতলক্ষ্যা নদীতে এসব লাশ গুম করার ঘটনা বারবার উঠে এসেছে। কিছু ক্ষেত্রে, সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে লাশ বাঁধা হতো যাতে লাশ ভেসে না ওঠে।

এছাড়া, হত্যার আগে ভিকটিমদের ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কিছু ঘটনায় ভিকটিমদের মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আরেকটি ঘটনায়, এক ভিকটিমকে রেললাইনের ওপরে রেখে ট্রেন দিয়ে লাশটি ধ্বংস করার পরিকল্পনা করা হয়।

গুম থেকে ফিরে আসা ৭৩% ভিকটিম জানিয়েছেন, তারা অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যমে নেতিবাচক প্রচারণার কারণে তাদের পরিবারকেও সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হতে হয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে গুমের ঘটনাগুলো কেবল অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। এর পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র রয়েছে। বিশেষত ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার কথা কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

গুমের পেছনে মূলত দুটি উদ্দেশ্য কাজ করত। প্রথমত, ভিকটিমদের নির্মূল করা। দ্বিতীয়ত, লাশ এমনভাবে গুম করা যাতে তা পুনরুদ্ধার বা শনাক্ত করা না যায়। এ ধরনের পরিকল্পিত এবং সুসংগঠিত গুমের ঘটনাগুলো বাংলাদেশে একটি গভীর সংকট তৈরি করেছে।

গুম কমিশনের এই প্রতিবেদন বাংলাদেশে গুমের ভয়াবহ চিত্র এবং এর পেছনের কৌশল ও ষড়যন্ত্র উন্মোচন করেছে। এটি কেবল একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়, বরং এর পেছনে আন্তর্জাতিক সংযোগও রয়েছে। এই ধরনের ঘটনা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এখন প্রয়োজন যথাযথ তদন্ত ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, যাতে গুমের এই চক্র চিরতরে বন্ধ করা যায়।

About Nasimul Islam

Check Also

মধ্যরাতে আটক মমতাজ

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নামে করা মিথ্যা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়েরকারী অ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন মেহেদীকে …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *