Friday , September 20 2024
Breaking News
Home / Countrywide / চলমান নির্বাচনে আ.লীগের প্রার্থীদের পরাজয়ের পেছনের কারন

চলমান নির্বাচনে আ.লীগের প্রার্থীদের পরাজয়ের পেছনের কারন

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দ্বিতীয় দফা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, আর এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রায় দুইশত’র ও বেশি মনোনীত প্রার্থীর পরাজয় ঘটেছে এবং এই খবর বিভিন্ন সামাজিক, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে।

অনেকেই বিষয়টিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়ারও চেষ্টা করেছেন। তবে এটা ঠিক যে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিষয়টি সর্বপ্রথমে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত, যে দৃষ্টিকোণ থেকেই হোক না কেন এটা থেকেই দলটিকে অভিজ্ঞতা নিতে হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের পরাজয় আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য একটি ভয়ের বিষয় হতে পারে। এই প্রতিনিধিরা যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা যেকোনো ধরনের নির্বাচনে বিশেষ করে সামনে যে সংসদ নির্বাচন আসছে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ে যারা নেতৃত্ব দেন তাদের উচিত দলের নিরপেক্ষ নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে এ ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করা যাতে আগামী নির্বাচনের আগে সমস্যাগুলো সংশোধনের সুযোগ থাকে।

প্রায় দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নিয়ে গবেষণা চালিয়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আমার খুব ভালো ধারণা আছে। এ অভিজ্ঞতার আলোকে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের পরাজয়ের বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছি।

প্রথম যে বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তুলছে সেটি হচ্ছে নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে দুর্বলতা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা হেরে গেছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রো’হী প্রার্থীর কাছে। এর অর্থ হচ্ছে বি’দ্রোহী প্রার্থীরা অবশ্যই আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর চেয়ে বেশ জনপ্রিয়। স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে দলীয় মনোনয়নের চেয়ে প্রার্থীদের ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা বেশি গুরুত্ব পায় ভোটারদের কাছে। স্থানীয় জনগণ সেসব প্রার্থীকে ভোট দেয় যারা সুখে-দুঃখে তাদের পাশে থাকে। এই থেকে বিচার করলে বোঝা যায় যে যারা মনোনয়ন পেয়েছেন এবং নির্বাচনে করেছেন তারা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের তুলনায় কম জনপ্রিয়। ফলে, প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে আরও বেশি সচেতন হওয়ার প্রয়োজন ছিল।

দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর থেকেই বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন গবেষণায় যে বিষয়টি উঠে এসেছে, সেটি হলো স্থানীয় পর্যায় থেকে কেন্দ্রে মনোনয়নের জন্য প্রার্থী তালিকা প্রেরণের ক্ষেত্রে এমপি এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দ নিজেদের পক্ষের নেতাদের নাম পাঠাতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে এর সঙ্গে মনোনয়ন বাণিজ্য যুক্ত হয়েছে। ফলে কে নিবেদিত আওয়ামী লীগের নেতা কিংবা জনপ্রিয় নেতা সেটা বিচার না করে কাকে মনোনয়ন প্রদান করা হলে স্থানীয় পর্যায়ে এমপি এবং নেতাদের বলয় শক্তিশালী হবে সে বিষয়টি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় নির্বাচনে বিদ্রো’হী প্রার্থীরা অনেক স্থানে বিজয়ী হয়েছেন। আমরা এমনও লক্ষ করেছি, বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। আবার অনেক কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ভোটশূন্য থেকেছেন।

এই বিষয়গুলো স্থানীয় সরকার নির্বাচন কেন্দ্রিক হলেও খুব গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত।

দ্বিতীয় যে কারণটি এ ধরনের ফলাফলকে প্রভাবিত করেছে তা হলো বিএনপির নির্বাচন বয়কট। কোথাও কোথাও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন এটা সত্য। কিন্তু তারা ভালো ফল করতে পারেনি। কারণ, সাংগঠনিকভাবে দেশজুড়ে দলটি খুবই দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার কৌশল নিয়েছে বিএনপি ও স্থানীয় নেতৃত্ব। তাদের মূল উদ্দেশ্য একদিকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে জনগণের সামনে আওয়ামী লীগকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা, অন্যদিকে স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কোন্দল বাড়ানো।

তৃতীয় যে কারণটি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে সেটি হচ্ছে সাংগঠনিকভাবে স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের দুর্বলতা। কেন্দ্র থেকে বারবার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার। কিন্তু স্থানীয় নেতৃত্ব দলীয় মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে একত্রিতভাবে করতে পারেনি। পাশাপাশি জনগণের মধ্যে দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার আবেগ তৈরি করতে পারেনি। এই ক্ষেত্রেও দলীয় কোন্দল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কারণ, মনোনীত প্রার্থীদের বিপক্ষের গোষ্ঠীগুলো চেষ্টা করেছে বিদ্রো’হী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার। এমনও দেখা গেছে, বিভিন্ন স্থানে এমপি এবং স্থানীয় নেতারা বি’দ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন। এর ফলে মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে।

স্থানীয় পর্যায়ে দলভিত্তিক নির্বাচন সারা পৃথিবীতে অনুশীলন করা হলেও বাংলাদেশ দেশে এর অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়। এই পদ্ধতি প্রবর্তনের ফলে দলীয় কোন্দল বৃদ্ধি পেয়েছে বিধায় সাংগঠনিকভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কারণ, দলীয়ভিত্তিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ফলে প্রার্থী মনোনয়নকে কেন্দ্র করে দল বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়েছে। এমপিদের আধিপত্যের সঙ্গে সঙ্গে উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের আধিপত্য বিস্তারের ঘটনা দলের মধ্যে কোন্দলের জন্ম দিয়েছে। এমপি এবং উপজেলা পর্যায়ের নেতারা সবসময় চেষ্টা করেছেন নিজেদের বলয়কে শক্তিশালী করার জন্য নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে মনোনয়ন প্রদানের জন্য কেন্দ্রের কাছে নাম পাঠাতে।

ফলে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে বিভিন্ন স্থানে হেরে গেছে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী, যা জনসাধারণের কাছে একটি ভুল বার্তা প্রদান করতে পারে।

ফলে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত বিপুল সংখ্যক প্রার্থী হেরে যাওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। আমরা জানি যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন বাংলাদেশকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যাওয়ার। ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা ব্যাপক উন্নয়ন অর্জন করেছি।

আমরা উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। আমরা এসডিজি লক্ষ্য অর্জন করার ক্ষেত্রে সঠিক পথেই রয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে রূপান্তর করার যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন সেই লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সরকারের ধারাবাহিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামী ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি বিজয়ী হতে না পারে তাহলে সেই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়।

আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় পর্যায়ের সব ক্ষেত্রে দলীয় সাংগঠনিক দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠে দলকে শক্তিশালী করাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর এই কাজটি করতে হলে প্রথমেই যেটা করা প্রয়োজন সেটি হচ্ছে দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা বাতিল করা। আমরা জানি ইতোমধ্যে ২০২১ সালে কয়েক ধাপে স্থানীয় সরকার নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। ফলে, এই মুহূর্তে নির্বাচন পদ্ধতি বাতিল করা সম্ভবপর না হলেও আগামী নির্বাচনগুলো যেন দলীয় ভিত্তিতে না হয় সেই ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনে আইন সংশোধন করার বিষয়টি সরকার সক্রিয়ভাবে চিন্তা করতে পারে।

আমরা জানি, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো নেতৃত্বের চাবিকাঠি। এখান থেকেই নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে এবং সেই নেতৃত্বই ভবিষ্যতে দেশকে নেতৃত্ব দেয়। ফলে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনই হতে পারে বাংলাদেশের জন্য সেরা। এতে করে একদিকে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন ব্যবস্থায় নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দলাদলি যেটা হয়ে থাকে সেটা বহুলাংশেই কমে যাবে। ফলে শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ যদি আগামিতে কয়েকবার ক্ষমতায় আসে তাহলে দেশ উন্নয়নের শীর্ষে পৌঁছে যাবে বলে সকলে বিশ্বাস করে থাকে।

আমার বিশ্বাস এটা যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টিকে হালকাভাবে নিচ্ছেন না, বরং গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছেন। এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার পাশাপাশি, সংসদ সদস্য এবং স্থানীয় নেতৃত্বে যারা রয়েছেন তাদের একটি অংশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে এই ধরনের বিষয়ে একটি শক্তিশালী বার্তা দেওয়া এখন সময়ের প্রয়োজন কারন যারা নিজেদের স্বার্থ চিন্তা থেকে নিজেদের বলয়কে শক্তিশালী করতে গিয়ে বরং দলের ক্ষতি করছে। এ দুটি কার্যক্রম যদি সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় তাহলে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অবশ্যই সুসংগঠিত হতে পারবে এবং আগামী নির্বাচনে দল পূনরায় ক্ষমতায় যেতে পারবে।

লেখনীতে, লোক-প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

 

About

Check Also

আ.লীগ ও তৃণমূল থেকে বিএনপিতে যোগদানের হিড়িক

নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও তৃণমূল বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে বিএনপিতে যোগদানের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *