সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দেশে নৈরাজ্য ও রাজনৈতিক সহিংসতার দায় স্বীকার করেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। এ ছাড়া দায় স্বীকার করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আলোচিত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল (চাকরিচ্যুত) জিয়াউল আহসান। এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুগান্তর। জানা গেছে, গত ১৬ আগস্ট নিউমার্কেট এলাকার পাপশ বিক্রেতা শাহজাহান আলী হত্যা মামলায় এই তিন আসামি রিমান্ডে থাকলেও তাদের বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। দেশে অরাজকতা ও রাজনৈতিক সহিসংতা সৃষ্টির নেপথ্যে কার কী ভূমিকা ছিল সে বিষয়ে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। শুরুতে তারা সাবেক স্বরাষ্ট্র ও সাবেক সেতুমন্ত্রীর ওপর দায় চাপালেও এখন দায় চাপাচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর।
তারা বলছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছি মাত্র।’ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা বাস্তবায়নে তারা যে পরিকল্পনা করেছেন তা বাস্তবায়নের জন্য মাঠপর্যায়ে নির্দেশ দিয়েছেন বলে ইতিমধ্যেই স্বীকার করেছেন তারা। হত্যার দায় স্বীকার করলেও গ্রেফতারকৃতরা এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেনি। ৫ মে, ২০১৩ সালে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণ ও হত্যাযজ্ঞ চালানো, বিশেষ উদ্দেশ্যে আড়িপাতার যন্ত্র ক্রয়, ভয় দেখিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে আয়নাঘর কনসেপ্ট তৈরি এবং বহু মানুষকে গুম-খুন করার বিষয়ে তাদের হাত রয়েছে বলে স্বীকার করেছে। সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক এবং মেজর জেনারেল (চাকরিচ্যুত) জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানা যায়। যেসব ঘটনায় মামলা হবে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-শেয়ার কেলেঙ্কারি, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজত ইসলামের নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণ-নিধন, আড়িপাতার যন্ত্র পেপাসাস সফটওয়্যার ক্রয়, আয়নাঘর কনসেপ্ট এবং অসংখ্য গুম-খুনসহ নানা আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রিমান্ডে থাকা সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জিয়াউল আহসানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নিউমার্কেট থানায় একটি হত্যা মামলায় তিনজনই এখন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। এ বিষয়ে যে মামলায় তাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে তার বক্তব্য সংশোধন করা হচ্ছে। শনিবার (১৭ আগস্ট) মামলার বাদী থানায় সংশোধিত জবানবন্দি দেন। পরে তা আদালতে পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে।
ডিএমপি নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা হকার (কাপড় বিক্রেতা) শাহজাহান আলী হত্যা মামলায় গত মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। বুধবার (১৪ আগস্ট) তাদের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে আদালত তাদের ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পরে তাদের আদালত থেকে সরাসরি ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতারের পর জিয়াউল আহসানকে একই মামলায় শুক্রবার (১৬ আগস্ট) আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। শুনানি শেষে আদালত তার ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তিনজনই এখন ডিবি হেফাজতে পুলিশের রিমান্ডে রয়েছে।
সূত্র জানায়, সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক এবং জিয়াউল আহসানকে দুটি টিমের মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। একটি টিমে আছেন নিউমার্কেট থানার ওসির নেতৃত্বে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ জুনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা। তারা মূলত থানা পুলিশের সদস্য। অপর একটি টিমে আছেন ডিএমপি সদর দপ্তর এবং ডিবির কর্মকর্তারা। এই টিমটি করা হয়েছে মূলত উচ্চ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে। জুনিয়র টিম কেবল মামলার রহস্য উদ্ঘাটনের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। তারা মামলার এজাহারে বর্ণিত অভিযোগের বাইরে কোনো বিষয় জিজ্ঞাসাবাদ করছেন না। আর সিনিয়র টিমটি জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে কেবল মামলার বিষয়বস্তুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছেন না। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। তবে ডিবির বেশিরভাগ পদস্থ কর্মকর্তা অন্যত্র বদলি হওয়া এবং নতুন আদেশপ্রাপ্ত সব কর্মকর্তা এখনো যোগদান না করায় ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ সম্ভব হয়নি। প্রভাবশালী আসামি হওয়ায় কেউ কেউ তাদের জিজ্ঞাসাবাদে ভয় পাচ্ছেন।
আসামিরা জিজ্ঞাসাবাদে কী ধরনের অভিব্যক্তি দেখাচ্ছেন জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, আনিসুল হক বেশির ভাগ সময় হাসছেন। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) যে নির্দেশনা দিয়েছেন আমি তা অনুসরণ করেছি। খুনের মামলায় আমাকে রিমান্ডে নিলেন কেন? যারা সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাদের গ্রেফতার করুন। জিয়াউল হক বলেন, ‘আমি কোনো ইউনিটের দায়িত্বে ছিলাম না। আমি সরকারের টপ অর্ডারের নির্দেশে কাজ করেছি।’ জিজ্ঞাসাবাদকারীরা তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি এনটিএমসি (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার) মহাপরিচালক ছিলেন। আড়ি পেতে মানুষের প্রাইভেসি নষ্ট করেছেন। আপনার নির্দেশেই বিরোধী মতের অনেককে আয়নাঘরে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়েছে। গুম-খুনের শিকার হয়েছেন অনেকে।’ তখন বলেন, ‘আমি তো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করেছি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছি। যে আয়নাঘরের কথা বলা হচ্ছে সেখানে আমাকেও আট দিন রাখা হয়েছে। এরপর আমাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।’
জানা যায়, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের শত শত নেতাকর্মী গুম ও হত্যার শিকার হয়েছেন। এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মিশন বাস্তবায়নে জিয়াউল আহসান সারাদেশে র্যাবের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তাকে ব্যবহার করেন। ছাত্র আন্দোলনের সময় গণভবন থেকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, আইজিপি এবং অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং কয়েকজন মন্ত্রীর ফোনালাপের রেকর্ডের সারসংক্ষেপ উদ্ধার করা হয়। তাতে আন্দোলন দমনে ইন্টারনেট বন্ধসহ নানা কৌশলের তথ্য বেরিয়ে আসে। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, জিয়াউল আহসান অনেকের ব্যক্তিগত ফোনালাপ রেকর্ড করতেন। তিনি বিশেষ করে বিএনপি নেতাদের কল রেকর্ড করতেন এবং তাদের কথা শুনতেন। কোটা সংস্কারের দাবি বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ব্যানারে আন্দোলন চলাকালে গত ১৭ জুলাই থেকে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ১৮ জুলাই থেকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ করা হয়। পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু করা হয়। তৎকালীন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক ও মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান ডাটা সেন্টারগুলো বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। কয়েকটি ডাটা সেন্টারে হুমকি দিয়ে বন্ধ করেন জিয়াউল আহসান।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মইনুল হাসান জানান, রিমান্ডে নেওয়া তিন আসামিকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে আরও অনেক মামলা হবে। তাদের কয়েকদিন রিমান্ডে নেওয়া হবে। তাই রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে এখনই কিছু বলা ঠিক হবে না। যে মামলায় সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক ও জিয়াউল আহসানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সেই মামলার বাদী আয়েশা বেগম বলেন, এই মামলার সময় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল। পুলিশ এজাহার লেখার সময় তার ছেলে হত্যার পেছনে ইচ্ছাকৃতভাবে অজ্ঞাতনামা কোটাবিরোধী জামায়াত-শিবির এবং বিএনপি জড়িত ছিল বলে উল্লেখ করে। অথচ তার ছেলে মারা গেছে পুলিশের গুলিতে। এজাহার লেখার পর তাকে পড়ে শোনায়নি। ছেলে হারানোর শোকে তিনি কাতর থাকায় সেই সুযোগে পুলিশ এজাহারে স্বাক্ষর নেয়। পরে এজাহারটি পড়ার পর ত্রুটি চোখে পড়ে বলে জানান তিনি।
বিষয়টি থানার ওসিকে জানালে তিনি বক্তব্য সংশোধনের প্রস্তাব করেন। সে অনুযায়ী শনিবার থানায় গিয়ে সংশোধিত জবানবন্দি জমা দিয়েছি। সংশোধিত বিবৃতিতে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের কথা বাদ দেওয়া হয়েছে। অভিযুক্তদের অজ্ঞাত অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন পুলিশের দায়িত্ব অপরাধীদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনা। নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুল ইসলাম বলেন, মামলার অভিযোগের বিষয়ে আমরা আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা তদন্তের স্বার্থে এই মুহূর্তে প্রকাশ করা যাবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মামলার বাদী যে সংশোধনী এজাহার থানায় জমা দিয়েছেন তা ইতোমধ্যে আদালতে পাঠানো হয়েছে।