Thursday , September 19 2024
Breaking News
Home / Crime / মডেল মসজিদ নির্মাণে ঘুষ-দুর্নীতি, স্বামীর বিরুদ্ধে যেসব প্রমাণ দিয়েছেন সেই প্রকৌশলীর স্ত্রী

মডেল মসজিদ নির্মাণে ঘুষ-দুর্নীতি, স্বামীর বিরুদ্ধে যেসব প্রমাণ দিয়েছেন সেই প্রকৌশলীর স্ত্রী

২০১৭ সালে, সরকার ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রসারের লক্ষ্যে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় মোট ৬৬৪টি মডেল মসজিদ এবং ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের একটি প্রকল্প হাতে নেয়। সময় বাড়ানোর পরও প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায়। প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়। প্রাথমিকভাবে ৮৪২ কোটি টাকা নেওয়া প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে প্রকল্পটি নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। তবে এ প্রকল্পে বারবার অনিয়মের অভিযোগে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ প্রকল্পকে বিতর্কিত করে তোলে অনিয়মকারীরা। মডেল মসজিদ নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত নীলফামারী গণপূর্ত বিভাগের সহকারী প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ঘুষ নেওয়ার প্রমাণসহ গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন ওই কর্মকর্তার স্ত্রী রেজওয়ান আহমেদ খুশবু।

জানা যায়, সহকারী প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামান দিনাজপুর গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে নীলফামারীতে যোগদান করেন। যোগদানের পর তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী অন্যান্য দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনের পর নীলফামারী সদর উপজেলা ও জলঢাকা উপজেলায় নির্মিতব্য ‘মডেল মসজিদ ও ইসলামিক কালচারাল সেন্টার’ নির্মাণ কাজের তদারকি করেন।

২০২৩ সালের মার্চের মধ্যেই নীলফামারী সদর উপজেলা মডেল মসজিদ নির্মাণকাজ শেষ হয়। সদর উপজেলা মডেল মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নির্মাণকাজের চুক্তিমূল্য ১৩ কোটি ৫ লাখ টাকা হলেও তা ১৬ কোটি ৯২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়। আর বর্তমানে জলঢাকা উপজেলার মডেল মসজিদ নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। এ দুই মসজিদ নির্মাণকাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৪৫ লাখ ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে।

তার স্ত্রী রেজওয়ানা হাসনাত খুশবু অভিযোগ করেছেন, “২০২১ সালের জুলাই বা আগস্ট মাসে, আমি আমার স্বামীকে মডেল মসজিদ নির্মাণের জন্য ঘুষ নেওয়ার বিষয়ে তার মোবাইল ফোনে একজন অপরিচিত ব্যক্তির সাথে কথা বলতে শুনেছি।” ফোনালাপ শেষে তাকে বললাম, মসজিদ আল্লাহর ঘর। তুমি এখান থেকে ঘুষ খাবে?’ সে খুব রেগে গিয়ে আমাকে গালি দেয়। এ সময় গর্ভে সন্তান থাকায় প্রচণ্ড রকম অপমানিত বোধ করলেও কাউকে কিছু বলিনি। কিন্তু এরপর থেকেই সামান্য ব্যাপারেও কথাকাটাকাটি হতে শুরু হয়। এভাবে ধীরে ধীরে শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন।

তিনি বলেন, স্বামী আমাকে বলে আমি এরকম থাকতে চাই না, বড়লোক হতে হবে। যদি মডেল মসজিদ থেকে ঘুষ নিতে না দিস তাহলে বাবার বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে আয়। সংসরারের সুখ-শান্তির কথা বিবেচনা করে নানা অজুহাতে তাকে ৭ লাখ টাকা এনে দেই। এ ছাড়া বিয়ের সময় আমার বাবার কাছ থেকে সাড়ে ১২ লাখ টাকা যৌতুক নেওয়া হয়। বিয়ের পর বাড়ি সংস্কারের কথা বলে আরও আট লাখ টাকা নেয়।

খুশবু আরও বলেন, তার স্বামী একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণে ঘুষ নেওয়ার খবর পেয়ে বারবার অনুরোধ করেও তাকে দুর্নীতি থেকে সরাতে ব্যর্থ হই। এমনকি দুর্নীতিতে বাধা দেওয়ায় আমাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। বলে, তুই ও তোর পরিবার আমার কিছুই করতে পারবি না। আমার ক্ষমতা ও টাকার কাছে তোরা ভেসে যাবি। এভাবে বলতে বলতে অনেক মারধর করে। তার ঘুষ গ্রহণের বিষয়টি মেনে নিলে চুপচাপ থাকলে সব স্বাভাবিক থাকত। নির্যাতন করত না। যখন সে সৎ ছিল তখন কোনো সমস্যা হয়নি।

তিনি আরও বলেন, সন্তান জন্মের একদিন পর মেসার্স আবদুর রাফি ট্রেডার্স নামে একটি কোম্পানির কাগজপত্র দেখতে পাই। তাকে জিজ্ঞাসা করি এটা কি? তখন তার উত্তর ছিল বিভিন্ন কাজে টাকা বিনিময় করতে হয় তাই এই প্রতিষ্ঠানটি করছেন। ধান, ভুট্টা, তামাকের ট্রেডিং হোক কিংবা না হোক, একটি প্রতিষ্ঠান থাকলে সুবিধা।

প্রকৌশলীর স্ত্রী জানান, মে মাসে ভুট্টা ক্রয় ছাড়া এ পর্যন্ত মের্সাস রাফি ট্রেডার্সে কোনো লেনদেন হয়নি। এ অ্যাকাউন্টে যে লেনদেন হয়েছে সেটিও অন্য উৎস থেকে। আর এফডিআর কখন, কোথায় এবং কোন উৎসের অর্থ দিয়ে করা হয়েছিল সেটিও সংসার জীবনে দেখিনি। নীলফামারীর চৌরঙ্গী থেকে সৈয়দপুরে রাস্তার কাজ থেকেও ৮৫ থেকে ৯০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছে। বিয়ের সময় অতি সাধারণ পরিবারের একজন সন্তান হলেও, বর্তমানে আমার স্বামীর রয়েছে বিলাসবহুল বাড়িসহ বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি। ঘুষ-দুর্নীতি ছাড়া এটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। দুর্নীতির তদন্ত এবং আমার ওপর নির্যাতনের প্রতিকার চাই।

প্রকৌশলীর স্ত্রী আরও বলেন, নীলফামারী সদর উপজেলার রূপালী ব্যাংকে আমার নামে একটি ব্যাংক হিসাব খুলে ব্যাংকের চেক বই দেওয়ার পর আমার স্বামী জোরপূর্বক ব্ল্যাঙ্ক চেকে আমার স্বাক্ষর নিয়ে নেয়। আমি সচিবের কাছে অভিযোগ করেছি। তিনি সুষ্ঠু তদন্তের আশ্বাস দেন। দোষী হলে তার শাস্তি হবে।

জানা যায়, আশরাফুজ্জামান গণপূর্ত বিভাগে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদানের আগে তার বাবা আবদুল মান্নানের একটি ওষুধের দোকানে পল্লী চিকিৎসক হিসেবে কাজ করতেন।তাদের বাড়ি বলতে ছিল একটি ঘর। কিন্তু পাঁচ বছরে বদল হয়েছে বাড়ির চেহারা। দুই কক্ষের ঘর থেকে হয়েছে পাঁচ কক্ষের আলিশান বাড়ি। বাড়ির চতুর্দিকে সীমানা প্রাচীর। নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন গেট।

আর বাড়ির একপাশে মেসার্স আব্দুর রাফি ট্রেডার্সের নামে একটি গুদাম ঘর। ২০২২ সালে মেসার্স আব্দুর রাফি ট্রেডার্সের ট্রেডলাইসেন্স নেওয়া হয়। ২০২৩ সালের মে মাসে প্রায় ১১০০ মণ ভুট্টা ক্রয় করে সেই গুদামঘরে গুদামজাত করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠান থেকে দৃশ্যত কোনো ভুট্টা বিক্রি হয়নি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের গত ৫ মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট হতে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে ৩৪ লাখ ৮৭ হাজার টাকা ডিপোজিট এবং ৩৩ লাখ ৪৬ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ২০২৪ সালের ৯ ও ১০ জানুয়ারি ৯ লাখ টাকা ও ৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা নগদ জমা হয়েছে। ২০২৪ সালের ৩১ মার্চে প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে এফডিআর ক্লোজড বাবদ ১৯ লাখ ৯৭ টাকা জমা হয়েছে।

মডেল মসজিদ প্রকল্পের পরিচালক নজিবুর রহমান বলেন, ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, তদন্ত শেষে নিয়োগ বিধি মোতাবেক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ।আমাদের কাছে অভিযোগ আসেনি। তবে আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব।

নীলফামারী গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী তৌহিদুজ্জামান বলেন, সহকারী প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামানের সঙ্গে তার স্ত্রীর পারিবারিক বিরোধ ছিল বলে জানতে পেরেছি। এ কারণে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এরপর মেয়েটি তার বিরুদ্ধে মামলা করে। ওই মামলায় তিনি জামিনে রয়েছেন।

অভিযুক্ত উপ-সহকারী প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামান বলেন, অভিযোগকারী আমার সাবেক স্ত্রী। আমি তাকে ৩ মার্চ তালাক দিয়েছিলাম। ২০২০ সালের এপ্রিলে তাকে বিয়ে করি। মে মাসের ৭ তারিখে আমার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন মামলা করে। পরে আমি জামিন পাই। এরপর থেকে আমার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র চলছে। হয়রানিমূলক এবং আমাকে ফাঁসানোর জন্য এসব বিষয় গোপন রেখে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে।

About Nasimul Islam

Check Also

হাসিনার পতনের পর সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বিপুল সম্পদের সন্ধান পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক

তিন দেশে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের বিপুল সম্পদের সন্ধান পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তার স্ত্রী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *