Monday , November 25 2024
Home / Countrywide / মেয়ের লেখাটাই বেশি কাঁদাচ্ছে: লামিশার বাবা

মেয়ের লেখাটাই বেশি কাঁদাচ্ছে: লামিশার বাবা

বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী লামিশা ইসলাম। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে বুয়েটের বার্ষিক ম্যাগাজিন ‘অযান্ত্রিক’-এ তার একটি লেখা প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘অ্যা ডোর কল্ড ডেথ’। মেয়ে এই শিরোনামে কেন লিখেছেন পুলিশ কর্মকর্তা বাবা মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম জানেন না। গত বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দফতরে তিনি দেশের একটি জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন,মেয়ের ওই লেখাটাই এখন সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছে। লামিশা মৃ/ত্যু নিয়ে যা লিখেছে, তার সঙ্গে এমন হবে, ভাবতেও পারিনি! বুয়েটের শিক্ষার্থী ও তার সহপাঠীরাও লেখা পড়ে কাঁদছে।

লামিশার লেখার শেষ অংশটা ছিল এরকম – আমি মা ডাক শুনতে পেলাম। আমি দাদীর বাড়ির পিছনে সেই বিশাল বনের মাঝখানে ছিলাম, যখন তার বিষণ্ণ কণ্ঠ বেজে উঠল। এবং তার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই মাটি কাঁপতে শুরু করে, যেন একটি দৈত্য তার পথ দিয়ে যাচ্ছে। ভিতরে টানেল। কিন্তু সেই প্রাণীর মুখোমুখি হওয়ার আগেই আমি আবার এই যন্ত্রণাদায়ক ‘মা’ শব্দের মুখোমুখি হলাম।

পুলিশ রিক্রুটমেন্ট অ্যান্ড ক্যারিয়ার প্ল্যানিং-১ (আরঅ্যান্ডসিপি) এর অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম জানান, ২০১৯ সালে লামিশা ও রাইশার মা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মা/রা যান। দুই মেয়েকে নিয়ে জীবন চলছিল। তারা ছিল আমার পৃথিবী। আমি এই বিশ্বাস নিয়ে যাচ্ছিলাম যে আমার জীবনে আর কাউকে হারাতে হবে না। সেই সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই এক দুর্ঘটনায় বড় মেয়ে লামিশাকে হারাতে হলো।ছোট মেয়েকে নিয়ে এত টেনশন করার করতে হতো না।ওকে নিয়ে বেশি টেনশন করা লাগত। মেয়েটি সর্বদা বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকত, তার নিজের যত্ন নেওয়ার সময় ছিল না।ওকেই হারাতে হলো আমার। ঘটনার দিন লামিশার সঙ্গে শেষ কথা হয় রাত সাড়ে ১০টা তিন মিনিটে। তখন বারবার বলছিলো, বাবা আমার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে, খুব কষ্ট হচ্ছে,ভিতরে এসে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও, আমাকে বাঁচাও। খুব অনুরোধ করে বলছিল, বাবা নিয়ে যাও। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি আমি।

গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টা ৫০ মিনিটে বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ৪৬ জনের মৃ/ত্যু হয়। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীও রয়েছে। এদের মধ্যে বুয়েটের শিক্ষার্থী নাহিয়ান আমিন ও লামিশা ইসলাম মা/রা গেছেন।

নাসিরুল ইসলাম বলেন, ওই দিন ছিল পুলিশ সপ্তাহের কর্মসূচি ছিল। সারাদিন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে ছিলাম। দুপুরের খাবারের পর বন্ধুদের সাথে বইমেলায় যায় লামিশা। সেদিন তিনি অনেক পছন্দের বই কিনেছিলেন। লামিশাও ভিডিও কলে ছোট বোন রাইশার সাথে তার প্রিয় বই কেনে। বই কেনার টাকা কম থাকায় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ফোন করে এক হাজার টাকা নেন। রাত ৯টার দিকে ফোন করে বলল, বাবা আমি মেলা থেকে চলে এসেছি। গাড়ি লাগবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, আমি রিকশায় ফিরব। ৪৫ মিনিট পর, তিনি আমাকে বললেন যে তিনি বেইলি রোডে আছেন। এর ১২ মিনিট পর রাত ৯টা ৫৯ মিনিটে ফোন করে বলেন, “বাবা, আমি বেইলি রোডের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে আটকে পড়েছি।” আগুন লেগেছে, তুমি তাড়াতাড়ি আসো, আমাকে বাঁচাও। আমি বলি, মা তুমি ঠান্ডা হও; উপরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করো। দুই মিনিট পর সে ফোন করলে বলে, “বাবা মনে হয় আমি বাঁচব না।” আমি জোর দিয়ে বলি, মা তুমি বাঁচবে, উপরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করো। লামিশা বলছিল, বাবা কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। তারপর বলি, যে কোনো উপায়ে উপরের দিকে যাওয়ার চেষ্টা কর। কিন্তু সে বার বার বলতে থাকে, বাবা আমি হয়তো বাঁচব না। ঘটনার পর দুবার কথা হয়েছে। এরপর কয়েকবার ফোন করেছি। কিন্তু মেয়েটি রিসিভ করেনি।

এই কর্মকর্তা কয়েকদিন ধরে কাজ করছেন। এদিকে তার ছোট মেয়ে রাইশা ইসলাম ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। বড় বোনের মর্মান্তিক মৃত্যুতে আগের চেয়ে চুপচাপ হয়ে গেছে। কারো সাথে কথা বলছে না।

নাসিরুল ইসলাম বলেন, লামিশা রাইশাকে বলেন, আমি যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (ট্রিপল-ই) ভর্তির সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু বাবাকে একা রেখে এখন দেশের বাইরে যাব। তাই ভর্তি বাতিল করেছি। কিন্তু আজ সে আমাকে ছেড়ে মায়ের কাছে গেল। কে এখন আমার কথা চিন্তা করে?

ভর্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান লামিশা। এর মধ্যে বুয়েটে ৫২২তম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ) ৫৩তম, রুয়েট ও টিউয়েটে ৩৫তম, আইইউটিতে ১৪২তম, মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে (এমআইএসটি) ২০৩তম, বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইউনিভার্সিটি (বুটেক্স) ১৪৭তম। ঢাবির ‘ক’ ইউনিটে ৩৬৫তম এবং ব্যাচে ৮২তম।

নাসিরুল ইসলাম বলেন, সব জায়গায় ভর্তি হওয়ার পর লামিশা আমাকে (নাসিরুল) জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা, আমার মতো সব জায়গায় ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলে হলে কোথায় ভর্তি হতে?’ আমি বললাম, ‘মা, সত্যি বলছি, আইবিএ-তে ভর্তি হয়ে যেতাম।’ বলে, ‘বাবা, আমি এখানে ভর্তি হব না।’

মাঝে মাঝে বাবার অফিসে আসতেন। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শ করে লামিশাকে বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি করা হয়। ভর্তির পর ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভের (সিআর) দায়িত্ব পান। নাসিরুল বলেন, প্রথম সেমিস্টারে মাত্র ছয়টি ক্লাস বাকি থাকতেই আকাশের তারকা হয়ে গেল!

About Babu

Check Also

বিশাল বড় দুঃসংবাদ পেলেন পুতুল

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের প্রতিষ্ঠিত সৌচনা ফাউন্ডেশনের সকল অ্যাকাউন্ট লেনদেন ৩০ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *