ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সাম্প্রতিক সময়ে মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে এবং বহিষ্কৃত হওয়ার পর এবারও সিটি করপোরেশনের মেয়র পদও হারাচ্ছেন। সেই সাথে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয় নিয়ে ক’টূক্তি এবং অবমাননা করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মাম’লা দায়েরের প্রস্তুতি চলমান আছে। দো’ষী সাব্যস্ত হলে তাকে আইনের ২১ ধারা অনুযায়ী তাকে ১০ বছর কা’রাদ/ণ্ড এবং সেই সাথে অন্য কোনো আইনে সা’/জা হতে পারে।
সরকারের হাইকমান্ডের নির্দেশে জাহাঙ্গীরকে মেয়র পদ থেকে অপসারণের আইন পর্যালোচনা করছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তাকে তার মেয়রের পদ থেকে অপসারন করতে হলে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের বিধান অনুযায়ী তা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনে তাকে নৈতিক স্খল’ন বা অসদাচরণের কারণে মেয়র পদ হতে সরিয়ে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে যে অপরা’ধে জাহাঙ্গীরকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে তা সিটি করপোরেশন আইনে নৈতিক স্খলন হিসেবে বিবেচিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। আইনের মাধ্যমে নৈতিক স্খলনের বিষয়টি আদালতে প্রমাণ করতে হবে।
জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুরের মেয়র থাকছেন কিনা, ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯’ পর্যালোচনার পর দু-একদিনের মধ্যে সেই বিষয়ে জানা যাবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। গতকাল সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষ থেকে মন্ত্রিসভা বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী বলেন, ‘আইনটা (সিটি করপোরেশন আইন) দেখে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইনটি পর্যালোচনা হোক তারপর বলব।’
স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের ১৩ ধারায় মেয়র ও কাউন্সিলর পদ থেকে অপসারণের কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো-(ক) যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া সিটি করপোরেশনের পর পর তিনটি সভায় অনুপস্থিত থাকেন; (খ) নৈতিক স্খল;নজনিত অপ/রা’ধে আদালতে দ’ণ্ডিত হন; (গ) দায়িত্ব পালন করতে অস্বীকার করেন অথবা শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে দায়িত্ব পালনে অক্ষম হন; (ঘ) অসদাচরণ বা ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন; (ঙ) নির্বাচনের অযোগ্য ছিলেন মর্মে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তিন মাসের মধ্যে প্রমাণিত হলে; (চ) বার্ষিক ১২টি মাসিক সভার পরিবর্তে ন্যূনতম ৯টি সভা গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া অনুষ্ঠান করতে বা ক্ষেত্রমতো সভায় উপস্থিত থাকতে ব্যর্থ হলে।
এখানে অসদাচরণ বলতে ক্ষমতার অপব্যবহার, আইন অনুযায়ী বিধিনিষেধ পরিপন্থী কার্যকলাপ, দু’র্নীতি, অসদুপায়ে ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণ, পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি, ইচ্ছাকৃত অপশাসন, নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব দাখিল না করা বা অসত্য দেওয়াকে বোঝাবে।
আইনে আরও বলা আছে-অপসারণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে বিধি অনুযায়ী তদন্ত ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকবে। সিটি করপোরেশনের কোনও মেয়র বা কাউন্সিলরকে পদ থেকে অপসারণ করা হলে, ওই আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতির কাছে আপিল করার বিধান রয়েছে। আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত অপসারণের আদেশ স্থগিত থাকবে বলে আইনে বলা আছে। সব পক্ষকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দিতে রাষ্ট্রপতি ওই অপসারণের আদেশ পরিবর্তন, বা’তিল বা বহাল রাখতে পারবেন। আপিলের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির আদেশই চূড়ান্ত গণ্য হবে। অপসারিত কোনও ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের কার্যকালের অবশিষ্ট মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য হবেন না।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলেন, সিটি করপোরেশন আইন অনুযায়ী, মেয়রের বিরুদ্ধে আদালতে কোনো মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ হলে তাকে সরিয়ে দিতে পারে সরকার। তবে এ প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ। মেয়রকে পদ থেকে সরানোর আরও দুটি সহজ উপায় আইনে আছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত, তার বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ আনা। দ্বিতীয়ত, কাউন্সিলরদের মাধ্যমে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন।
তরতর করে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। সবকিছু ভালোই চলছিল বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু সেই সুখ আর কপালে সইল না। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কারের পর মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় থেকে তার ছবি নামিয়ে ফেলা হয়েছে। এছাড়া মহানগরীর অন্যান্য দলীয় কার্যালয় থেকেও তার ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কোনাবাড়ী, টঙ্গী, সালনাসহ গাজীপুরের কয়েকটি দলীয় কার্যালয়ে সাঁটানো জাহাঙ্গীরের ছবি ছিঁড়ে উল্লাস করেছেন তার বিরোধী পক্ষের নেতা-কর্মীরা।
রবিবারের মতো গতকালও মেয়র জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুর জেলা শহরের নগর ভবনে যাননি। গতকাল প্রায় সারাদিনই নগরীর ছয়দানা এলাকায় বাসভবনে অবস্থান করেন মেয়র। বিভিন্ন কাজে এসে তাকে না পেয়ে সেবাপ্রার্থীরা ফিরে যান। তার ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, মেয়রের পদ রক্ষায়ও তেমন মনোযোগ নেই তার। জাহাঙ্গীর মনে করছেন, এই পর্যায়ে তার নামে মাম’লাও দেওয়া হতে পারে। তাই বেশি চেষ্টা করছেন যাতে মামলা ঠেকানো যায়। গত তিন দিন নিজের আয়কর ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি ও আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শেই কেটেছে জাহাঙ্গীরের। সম্ভাব্য কোন জায়গাগুলোতে আট’কাতে পারে জাহাঙ্গীর সেই ফাঁকফো’কর বন্ধ করার চেষ্টা করেছেন।
এদিকে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন গাজীপুরের পাঁচ কাউন্সিলরও। একটি ভিডিও ক্লিপে তাদের সরাসরি হত্যার হু’/ম’কি দেওয়ায় তারা মা’/ম’লা করবেন বলে জানিয়েছেন। পাঁচ কাউন্সিলর হচ্ছেন ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের আবু বক্কর, ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের আবদুল্লাহ আল মামুন মণ্ডল, ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডের নুরুল ইসলাম, কাউন্সিলর আমজাদ হোসেন ও ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের শাহজাহান মিয়া সাজু।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে যে মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেখানে তিনি অন্য যেসকল প্রার্থী ছিলেন তার মধ্যে তিনি সবচেয়ে ধনী প্রার্থী ছিলেন। জাহাঙ্গীর আলম তার যে বার্ষিক আয় দেখিয়েছিলেন সেটা ২.১৬ কোটি টাকার ও বেশি দেখিয়েছেন – যা নির্বাচনে প্রতিদ্ব’ন্দ্বিতাকারী অন্য যে আট জন প্রার্থী তাদের সম্মিলিত আয়ের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি।
এদিকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের ক্ষমতাচ্যুত সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের হাতে এর আগে যে সকল নেতারা নি/র্যা’তন এবং নানা সময়ে বিভিন্ন কারনে নি’/পী’ড়নের শি’/কার হয়েছিলেন তারা এবং তার অনুসারী যারা রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে মাম’লা দা’য়েরের প্রস্তুতি চলছে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ি এলকার কোনপাড়া নামক স্থানে অ্যান্টিকেসি গার্মেন্টস (মেয়র জাহাঙ্গীরের দখলে) এর একশো’রও বেশি কর্মী রয়েছেন যারা জাহাঙ্গীরের আলমের বিরুদ্ধে তাদের যে সঞ্চয়ের অর্থ সেটা আ’ত্মসাতের জন্য মামলা দায়ের করতে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে।