ডলফিন সেভিংস অ্যান্ড ক্রেডিট কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে প্রায় ১৫ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ঘটনাটি ঘটেছে নওগাঁ জেলায়।
এতে ওই কোম্পানির অন্তত ৬০০ গ্রাহক তাদের জীবনের শেষ সঞ্চয় হারিয়েছেন। কষ্টার্জিত টাকা ফেরত পেতে প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করছেন তারা।
জানা যায়, একই গ্রামের নাসির উদ্দিনের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক ২০১৩ সালে সমবায় থেকে নিবন্ধন নিয়ে নওগাঁ সদর উপজেলার ফতেপুর বাজারে ডলফিন সেভিংস অ্যান্ড ক্রেডিট কোঅপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। যেখানে তিনি বিভিন্ন গ্রামের সহজ-সরল মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে স্থায়ী আমানত ও ক্ষুদ্র সঞ্চয় কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন।
প্রতি লাখে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা করে মুনাফা দিতেন গ্রাহকদের। এই সংগঠনের পরিচালক আবদুর রাজ্জাক হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়েছেন। গত এক সপ্তাহ ধরে ওই কার্যালয়ের প্রধান ফটকে তালা ঝুলছে। তালা দেখে গ্রাহকদের অফিসে ফিরে আসতে হয়। এ নিয়ে চিন্তিত গ্রাহকরা।
বাড়তি লাভের আশায় কেউ মেয়ের বিয়ের জন্য, কেউ বিদেশে যাওয়ার জন্য, কেউ গরু-ছাগল বিক্রি করে আবার কেউ দিনমজুরের কাজ করে টাকা রোজগারের জন্য শেষ জীবনের সঞ্চয় রেখেছিলেন এই সংগঠনে। তারা লাভও পেতেন। তবে অধ্যক্ষ ফেরত দিতে চাইলে বাধার মুখে পড়েন। পরিচালকের বিরুদ্ধে নানা হুমকি দেওয়া হয়। পরিচালক হঠাৎ করে সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ করে পালিয়ে যাওয়ায় এখন পথে নামছে গ্রামের সহজ-সরল মানুষ।
স্থানীয়রা জানান, যথাযথ তদারকির অভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যাঙের ছাতার মতো বেড়ে উঠছে। গ্রামের সহজ-সরল মানুষ বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে একসময় পালিয়ে যায়। অন্তত ৬০০ গ্রাহকের ১৫ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে এই কোম্পানি।
ফতেপুর গ্রামের দিনমজুর আলম হোসেন কান্নাজড়িত সুরে বলেন, অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চলে। দিন আনা দিন খাওয়া অবস্থা; দুই মেয়ে তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে গত কয়েক বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানে বছরে দেড় লাখ টাকা সঞ্চয় করেছি। কিন্তু আমি শেষ. এখন রাস্তায় বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না।
এলাকার নাপিত সাইদুল ইসলাম জানান, কাজ করে সংসারের খরচ চালানোর পাশাপাশি প্রায় এক লাখ টাকা সঞ্চয় করে কয়েক বছর আগে এই প্রতিষ্ঠানে জমা দিয়েছি। মাসে দুই হাজার টাকা আয় করতাম। টাকার প্রয়োজনে গত কয়েক মাস ধরে ৪০ হাজার টাকা তোলা হয়েছে। গত কয়েকদিন থেকে অফিসে তালা ঝুলছে। মালিক আবদুর রাজ্জাককে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার বাড়িতেও তালা দেওয়া ছিল।
গৃহবধূ মাসুদা বানু বলেন, বাড়ির পাশেই এনজিও। বিদেশ যাওয়ার জন্য দুই লাখ টাকা রেখেছিলাম। আবদুর রাজ্জাক দশ মাস আগে আমার কাছ থেকে জোর করে টাকা নেয়। প্রতি লাখে আড়াই হাজার টাকা মুনাফা দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়েছে দুই হাজার টাকা। গত চার মাস থেকে আমি মূল অর্থ সংগ্রহের জন্য অপেক্ষা করছি। টাকা না দিয়ে এবং হুমকি দিয়ে সময় নষ্ট করা। সে এখন পালিয়েছে। টাকা পাব কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় সময় কাটাচ্ছি।
নাহিদা আক্তার নামে এক গৃহবধূ বলেন, স্বামীকে না জানিয়ে দেড় লাখ টাকা এই প্রতিষ্ঠানে রেখেছি। স্বামী পরে জানতে পারে। এ নিয়ে ঝগড়াও হয়। আমরা যাদের টাকা আছে তারা সবাই টাকার কষ্টে আছি। কষ্টার্জিত টাকা ফেরত পেতে প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করছি।
ফতেপুর পূর্বপাড়ায় আব্দুর রাজ্জাকের গ্রামের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, কেউ না থাকায় বাড়ির প্রধান দরজা তালাবদ্ধ। তবে আবদুর রাজ্জাকের বড় ভাইয়ের বাড়িতে তার বাবা-মা থাকেন।
আব্দুর রাজ্জাকের মা মর্জিনা বেগম জানান, তার ছেলে একসময় বিদেশে ছিল। এরপর গ্রামে এসে বিভিন্ন দোকানে কাজ করেন। তারপর একটি এনজিও (বেসরকারি সংস্থা) দেয়। গত কয়েকদিন ধরে ছেলেটির দেখা নেই। তবে কত টাকা লেনদেন হয়েছে তা একমাত্র ছেলেই বলতে পারবে বলে জানান তিনি।
নওগাঁ জেলা সমবায় কর্মকর্তা খোন্দকার মনিরুল ইসলাম জানান, গত জুন মাসে প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে ৩৮ লাখ টাকা জমার তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু ৬ মাসের ব্যবধানে কীভাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে যা অসম্ভব। তবে অ্যাসোসিয়েশনের সামনে আত্মসাতের জন্য বা সাইনবোর্ড ব্যবহার করে ব্যক্তিগতভাবে লেনদেন করা হয়েছে কিনা তাও দেখা হবে। গত কয়েকদিন আগে কয়েকজন ভুক্তভোগী এসে টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেন। এ ধরনের কোনো তথ্য পাওয়া গেলে কোম্পানির নিবন্ধন বাতিলসহ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।