বেফাঁস কথা বিতর্কিত কাজ, যেসব কারণে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই হলো না তাদের

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২২২ আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। এই নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর নতুন সরকার গঠন করতে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটি। টানা চতুর্থবারের মতো নতুন মন্ত্রিসভায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। প্রথমবারের মতো তার নতুন মন্ত্রিসভায় ১৪ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।

বিদায়ী মন্ত্রিসভার অনেকেই এই নতুন মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি। এর মধ্যে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে দুই টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। এছাড়া আগের মন্ত্রিসভার তিন সদস্য নির্বাচনে পরাজিত হন। আর এবার দলীয় মনোনয়ন পাননি আরও তিনজন। তবে বাদ পড়া একজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী নতুন মন্ত্রিসভায় ফিরেছেন।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দাপ্তরিক কাজে অবহেলা, অনুপস্থিতি, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা, সম্পর্কের অবনতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন, স্বজনপ্রীতি ও নেতাদের সঙ্গে দূরত্বসহ নানা কারণে নতুন মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি অনেকেই। কর্মী
বিজ্ঞাপন

বুধবার (১০ জানুয়ারি) রাতে সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের কাছে নতুন মন্ত্রিসভার তালিকা প্রকাশ করেন। মাহবুব হোসেন। বিদায়ী মন্ত্রিসভার ২৮ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী এই তালিকায় স্থান পাননি। বাদ পড়াদের মধ্যে ১৪ মন্ত্রী, ১২ জন প্রতিমন্ত্রী ও দুই উপমন্ত্রী রয়েছেন।

মন্ত্রিত্ব হারানোর পেছনে কী আছে?

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দাপ্তরিক কাজে অবহেলা, অনুপস্থিতি, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা, সম্পর্কের অবনতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন, স্বজনপ্রীতি ও নেতাদের সঙ্গে দূরত্বসহ নানা কারণে নতুন মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি অনেকেই। কর্মী এসব নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। এছাড়া একাধিক মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকে নতুন মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়ে নতুনদের জায়গা দেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।

যারা নতুন সরকারে পূর্ণ মন্ত্রী
মন্ত্রিসভার তালিকা থেকে জানা গেছে, নতুন মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় নিচ্ছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সমাজকল্যাণমন্ত্রী ড. নুরুজ্জামান আহমেদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ. রেজাউল করিম, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মোঃ শাহাব উদ্দিন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক বীর বাহাদুর উশাই সিং, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ।

জানা গেছে, এবার মন্ত্রিসভা গঠনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ব্যক্তিদের। এছাড়া বারবার এমপি হয়েছেন এমন ব্যক্তিদেরও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে
এ ছাড়া শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু, শ্রম ও কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ড. মোঃ এনামুর রহমান, বেসামরিক বিমান পরিবহন প্রতিমন্ত্রী ড. পর্যটন। মাহবুব আলী, মহিলা ও শিশু প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা।

শেখ হাসিনাকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো
অন্যদিকে বাদ পড়ার তালিকায় থাকা দুই উপমন্ত্রী হলেন- পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার এবং পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম।

নতুন মন্ত্রিসভায় যারা গুরুত্ব পেয়েছেন

জানা গেছে, এবার মন্ত্রিসভা গঠনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ব্যক্তিদের। এছাড়া বারবার এমপি হয়েছেন এমন ব্যক্তিদেরও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারকে দুটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বলে অনেকে মনে করেন। এগুলো হলো- অর্থনৈতিক সংকট ও কূটনৈতিক তৎপরতা- সম্পর্কের উন্নয়ন। এসব বিবেচনায় পুরনো মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা হয়তো অর্থ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাদ পড়েছেন।

সর্বমহলে আলোচনা-সমালোচনায় ছিল মন্ত্রীদের যেসব বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড

‘বিএনপিকে নানা প্রস্তাব দিয়েও নির্বাচনে আনা যায়নি, এমনকি নির্বাচনে এলে বিএনপি নেতাদের জেল থেকে মুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়’— এমন বিস্ফোরক মন্তব্যের কারণে বাদের তালিকায় থাকতে পারেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। মূলত, ওই বক্তব্যই মন্ত্রিসভা থেকে তার বাদ পড়ার কারণ বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নিত্যপণ্যের বেসামাল বাজারদর এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা অসহনীয় হয়ে ওঠার পরও এসব নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বাদ পড়তে পারেন। এর মধ্যে একবার বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি হঠাৎ মন্তব্য করে বসেন, ‘আমরা সিন্ডিকেটের সঙ্গে পারি না’। বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ছাড়াও নিত্যপণ্যের সিন্ডিকেটের কাছে এই ‘আত্মসমর্পণ’কে মন্ত্রীর পদ থেকে বাদ পড়ার মূল কারণ হিসেবে দেখছেন অনেকে। অবশ্য, অসুস্থতার কারণে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বাদ পড়তে পারেন, এমন আলোচনা আগে থেকেই ছিল।

করোনাকালে নানান কারণে সমালোচিত হতে থাকেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। করোনার টিকা নিয়ে সীমাহীন অব্যবস্থাপনা ও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। মানিকগঞ্জে সরকারি ওষুধ কারখানার জন্য যে এলাকায় জমি অধিগ্রহণ করা হবে, সেই জায়গাগুলো নিজে, ছেলে-মেয়ে, ভাইয়ের নামে কেনার অভিযোগে বিতর্কিত হন এই মন্ত্রী। এসব কারণে নতুন মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়তে পারেন তিনি
অন্যদিকে, বিভিন্ন সময়ে দেওয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে নানান বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। এছাড়া, করোনা মহামারির সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে জাহিদ মালেককে নিয়েও নানা সমালোচনা ছিল। এসব কারণে বাদ পড়তে পারেন তারা।

করোনাকালে নানান কারণে সমালোচিত হতে থাকেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। করোনার টিকা নিয়ে সীমাহীন অব্যবস্থাপনা ও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। মানিকগঞ্জে সরকারি ওষুধ কারখানার জন্য যে এলাকায় জমি অধিগ্রহণ করা হবে, সেই জায়গাগুলো নিজে, ছেলে-মেয়ে, ভাইয়ের নামে কেনার অভিযোগে বিতর্কিত হন এই মন্ত্রী। এসব কারণে নতুন মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়তে পারেন তিনি।

তাছাড়া, ‘কচুরিপানা খাওয়া’ এবং নিকলীর সড়কে অর্থ অপচয়সহ নানান মন্তব্য করে তীব্র সমালোচনার মধ্যে পড়েন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম. এ. মান্নান। তার মন্ত্রিত্ব হারানোর পেছনে এগুলোও কারণ হতে পারে।

বিস্তর অভিযোগ ছিল পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে। তার ছেলে, ভাই, স্বজনরা মিলে পাহাড়ের জায়গা দখলের অভিযোগ, বনের গাছ নিয়ে অভিযোগ, জনপ্রতিনিধি হয়েও নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে ঠিকাদারি কাজের অভিযোগসহ নানা কারণে সমালোচনার মধ্যে পড়েন শাহাব উদ্দিন। যা মন্ত্রিসভা থেকে তার বাদ পড়ার কারণ হতে পারে বলে ধারণা অনেকের।

এবার মন্ত্রিসভায় দলের সক্রিয় নেতাদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অনেকের ধারণা, এখান থেকে কারও কারও বাদ পড়া হয়ত যৌক্তিক। আবার কারও কারও বাদ পড়ার পেছনে কী কারণ তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা
অন্যদিকে, দলের মনোনয়ন ও মন্ত্রিত্ব দুইটিই হারিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন এবং সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। আর মনোনয়ন পেলেও নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরে যান তিন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, স্বপন ভট্টাচার্য্য ও এনামুর রহমান।

এর আগে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি অনেক পুরোনো মুখ। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণের চেয়ে নতুনদের জায়গা দেওয়ার জন্যই মনোনয়ন পাননি অনেকে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার মন্ত্রিসভায় দলের সক্রিয় নেতাদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অনেকের ধারণা, এখান থেকে কারও কারও বাদ পড়া হয়ত যৌক্তিক। আবার কারও কারও বাদ পড়ার পেছনে কী কারণ তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, এবার মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রে দলীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ব্যক্তিদের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, বারবার সংসদ সদস্য হয়েছেন, এমন ব্যক্তিদের কথা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে বলেও মনে করছেন অনেকে।

প্রসঙ্গত, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২২২টিতে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। একাদশ সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে পেছনে ফেলে স্বতন্ত্র হয়ে নির্বাচিত হয়েছেন ৬২ জন; যাদের মধ্যে ৫৯ জন আওয়ামী লীগেরই নেতা। আর জাতীয় পার্টির আসন অর্ধেকের বেশি কমে নেমেছে ১১টিতে। দুটিতে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগের শরিক দল জাসদ ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি এবং একটিতে জয় পেয়েছে কল্যাণ পার্টি। একটি আসনের ভোটগ্রহণ স্থগিত রয়েছে।

এদিকে, বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে নতুন মন্ত্রিসভায়। নতুন মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি বিদায়ী মন্ত্রিসভার অনেকেই। আর প্রথমবারের মতো যুক্ত হচ্ছেন ১৪ জন। নতুন মন্ত্রিসভার সদস্য ৩৭ জন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ শপথ নিচ্ছেন নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যরা। ইতোমধ্যে ২৫ জন পূর্ণ মন্ত্রী ও ১১ প্রতিমন্ত্রীর তালিকা প্রকাশ করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।