ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বৃদ্ধির পর দেশের মানুষ যারা প্রতিবাদ করতে পারছেন না তারা একসাথে এতটা বেশি দাম বাড়ানোয় ক্ষুদ্ধতা প্রকাশ করছে। যার প্রভাব ইতিমধ্যে সকল ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দামের উপর প্রভাব ফেলেছে। তেল এবং ডিজেলের দাম বাড়ার পর এবার বাড়ার সম্ববনার কথা বলা হয়েছে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে দামের সমন্বয় ঘটানোর জন্য তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম বাড়াতে চাইছে সরকার।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রের বরাতে জানা গিয়েছে যে, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করার জন্য ইতিমধ্যে একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করার কাজ শুরু হয়েছে। খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পর এবং আন্তর্জাতিক বাজারে যদি তেল এবং গ্যাসের দাম না কমে তাহলে এই চলতি মাসেই দাম বৃদ্ধি করার ঘোষণা আসতে পারে।
জ্বালানি বিভাগের যারা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তারা বলছেন, উচ্চমূল্যে এলএনজি ক্রয়ে সরকারকে কতটা ভর্তুকি দিতে হবে তা হিসাব করছে ছয় গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানী। আর্থিক বিশ্লেষণের পর কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেবে। একই সঙ্গে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করবে।
দেশে গ্যাসের চাহিদা পূরণে এলএনজি আমদানি করছে সরকার। এই এলএনজি জাতীয় গ্রিডে দেশীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের সঙ্গে সরবরাহ করা হচ্ছে, কিন্তু এলএনজির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে পাঁচ গুণ। এ অবস্থায় ভর্তুকি দিয়ে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত রাখা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বাজেটে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। অথচ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই এলএনজি আমদানিতে সরকারের ভর্তুকি লেগেছে ১০ হাজার কোটি টাকা। এই পরিস্থিতিতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে বিদ্যুতের দামও বাড়বে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্যানুযায়ী, সরকার গত ১১ বছরে ১০ বার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। এ সময়ে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বেড়েছে ১১৮ শতাংশ। খুচরা পর্যায়ে বেড়েছে ৯০ শতাংশ। সর্বশেষ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য মতে, দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুেকন্দ্রে অন্তত এক হাজার ৪০০ এমএমসিএফডি (প্রতি মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) গ্যাসের প্রয়োজন হয়। গ্যাস সংকটে বর্তমানে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। এই দুই জ্বালানির দাম বাড়ায় তেলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রর উৎপাদন খরচ আরো বেড়েছে। এ অবস্থায় পিডিবির চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকায় ঠেকবে। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১১ হাজার কোটি টাকা।
সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় বেড়েছে পরিবহন খরচ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিজেল ও কেরোসিনের দামের সঙ্গে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়লে উৎপাদন খরচ এবং মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম দেশের একটি গনমাধ্যমকে বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতিও কিছুটা বাড়বে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম না কমলে ভর্তুকি বাড়তেই থাকবে। এতে করে বাজেট ঘাটতির মাত্রাও বাড়বে আর সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে। এ পরিস্থিতিতে সরকারকে কিছুটা সমন্বয় করতে হবে, কিন্তু দাম যাতে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়, সে চেষ্টা করতে হবে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে গ্যাস উত্তোলন হচ্ছে প্রতিদিন দুই হাজার ৯০০ ঘনফুটের মতো। ঘাটতি রয়েছে এক হাজার ৩০০ ঘনফুট। চাহিদার বিপরীতে গ্যাসের জোগান দিতে হলে প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজার ঘনফুট এলএনজি আমদানি করে সরবরাহ করতে হবে। বর্তমানে গড়ে জাতীয় গ্রিডে দেওয়া হচ্ছে ৬০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি।
জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান বলেন, এলএনজি আমদানিতে যে পরিমাণ খরচ তা মেটানোর মতো যথেষ্ট সামর্থ্য পেট্রোবাংলার নেই। আগামী মাসে এক জাহাজ এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হবে প্রায় এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এই অর্থ পেট্রোবাংলার পক্ষে জোগাড় করা কষ্টসাধ্য।
জানতে চাওয়া হলে অধ্যাপক এম তামিম যিনি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ তিনি দেশের একটি জনপ্রিয় গনমাধ্যমকে বলেন, গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে সরকার অন্য কোনো উপায় দেখতে পারছে না কারন এলএনজিতে একটি বড় অঙকের অর্থ ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। তবে বিদ্যুতের দাম স্থিতিশীল রাখতে পারলে ভালো হয়। নিজস্ব গ্যাস উত্তোলনও কমে আসছে। এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে কত দিন ভর্তুকি দিতে সক্ষম হবে সেটাও ভাববার বিষয়।
মো. তামিম বলেন, জ্বালানি তেলের দাম এখন যদি বাড়ানো না হয় তাহলে আগামী ছয় মাস সময়ের মধ্যে সরকারকে ১৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের যে দাম বেড়েছে সেটা অনেক। ৬০ ডলার দামছিল এখন সেটা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪ ডলারে। অন্যদিকে গেল বছর স্পট মার্কেটে এলএনজির যে দাম ছিল সেটা ৫ ডলারের নিকটে, এখন সেটা বেড়ে দাড়িয়েছে ৩৪ ডলারে। দফায় দফায় এভাবে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারনে গণপরিবহন ভাড়া এবং পণ্যের বাজারকে কঠোরভাবে ধাক্কা দিয়েছে। গ্যাসের দাম যদি বাড়তো তাহলে এমনটি হতো না। এক্ষেত্রে কোনো কিছুর দাম বৃদ্ধি করবার পূর্বে সরকারের ভাবা উচিত, মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে।