২০২২ সালে, আব্দুল হান্নান রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার নির্বাচন কর্মকর্তা ছিলেন। সেবার সপ্তম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বালাহাট ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডে অবৈধভাবে সদস্য প্রার্থী রফিকুল ইসলামকে বিজয়ী করতে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। সে সময় এ সংক্রান্ত একটি ফোনালাপও ছড়িয়ে পড়ে। ঘুষের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রার্থীকে সাময়িকভাবে বরখাস্তও করে নির্বাচন কমিশন। তার বিরুদ্ধে সেবা প্রার্থীকে জেতাতে সাড়ে চার লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
এরপর ২০২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশনের আদেশে তাকে বরখাস্ত করা হয়। এবার সেই ব্যক্তি জাতীয় নির্বাচনে রাজশাহী জেলার সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পেয়েছেন। গত মে মাস থেকে তিনি রাজশাহী জেলা নির্বাচন অফিসের বোয়ালিয়া থানার নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। দেড় বছর আগে তার ফাঁস হওয়া দুর্নীতির ফোন কল এবং তাকে বরখাস্ত করার ঘটনাটি আবার সবার সামনে এসেছে, যা জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের মধ্যে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিষয়টি রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার পর্যন্ত গড়িয়েছে।
এবারই প্রথম রাজশাহী-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিলেন রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা।তিনি বলেন, একজন নির্বাচন কর্মকর্তা ইউপি নির্বাচনে মেম্বার প্রার্থীর কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন এমন অভিযোগে বরখাস্ত হয়েছেন। তাকে জাতীয় নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা বানানোর কথা শুনেছি। যদি তাই হয় তবে বিষয়টি মেনে নেয়ার মতো নয়। খোঁজ খবর নিয়ে রিটার্নিং কমকর্তাকে বিষয়টি জানাবেন তিনি বলে জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক প্রার্থী বলেন, এ ধরনের কর্মকর্তারা নির্বাচনে দুর্নীতি করতে পারে। আগের ঘটনার ওপর ভিত্তি করে অভিযুক্তকে এত বড় দায়িত্ব দেওয়া ঠিক নয়। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেন তিনি। রাজশাহী-৩ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আসাদুজ্জামানের ছোট ভাই রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুরুজ্জামান টুকু বলেছেন, কোনো বিতর্কিত কর্মকর্তাকে নিয়ে আমরা নির্বাচন করতে চাই না। তাকে অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি তোলা হবে।।
তবে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অভিযোগ ওঠার পর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে গত দেড় বছরে তদন্ত করা হয়। তদন্তে কিছু প্রমাণ না হওয়ায় তাকে অন্য থানায় বদলি করা হয়। রাজশাহী জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. শাহিনুর ইসলাম জানান, গত মে মাস থেকে তিনি রাজশাহী জেলা কার্যালয়ে থানা নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় শাস্তি দেওয়া হয়নি। ফলে আগামী নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে তার দায়িত্ব পালনে কোনো বাধা নেই।
কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান বলেন, আমি বর্তমান কর্মস্থলে ১৩ মার্চ ২০২৩ সালে যোগদান করি। ওই সময় তাকে বরখাস্ত করা হয় বলে স্বীকার করে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা। কারণ অভিযোগের সুরাহা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে।
২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার ১৭টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের আগে বালারহাট ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের সদস্য প্রার্থী রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান বলেন, নির্বাচনে কম ভোট পেলেও ফলাফল ঘোষণা হলে তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হবে। এ জন্য ওই ইউপি সদস্য নির্বাচন কর্মকর্তার সঙ্গে সাড়ে চার লাখ টাকার চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী ইউপি সদস্য প্রার্থী রফিকুল ইসলাম তাকে তিন লাখ টাকা দেন।
নির্বাচন কর্মকর্তার সঙ্গে ইউপি সদস্যের ফোনালাপের অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তোলপাড় শুরু হয়। ভোট গ্রহণের আগে প্রার্থী ও নির্বাচন কর্মকর্তার মধ্যে এমন গোপন সমঝোতার অডিও ফাঁস হওয়ায় ওই ওয়ার্ডের অন্য প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুল হান্নানকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে নির্বাচনের আগে কুড়িগ্রাম নির্বাচন অফিসে সংযুক্ত করা হয়। তার স্থলে পীরগাছা নির্বাচন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে অভিযুক্ত নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান প্রথম থেকেই বিষয়টি অস্বীকার করে আসছিলেন।
এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেন নির্বাচন কমিশন। তদন্ত কমিটি প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুল হান্নানকে বরখাস্ত করা হয়।