ব্যাপক সমালোচনার মুখে অবশেষে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেওয়া বন্ধ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে সরকার ঋণের জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংক ও নন-ব্যাংক আর্থিক খাতের ওপর নির্ভর করছে। এতে এসব খাত থেকে সরকারের ঋণ বেড়ে যায়।
তবে সামগ্রিকভাবে গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে সরকারের ব্যাংক ঋণ কমেছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের কারণে একদিকে উন্নয়ন প্রকল্প কম বাস্তবায়িত হচ্ছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক মন্দা ও সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে ব্যবসায়িক কার্যক্রমও কমে গেছে। এসব কারণে সরকারের ঋণ গ্রহণ কমেছে।
টাকা ছাপিয়ে বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বাজারে গিয়ে ওই অর্থ দ্বিগুণের বেশি মুদ্রা সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। এটি পণ্যের দাম বাড়াতে সাহায্য করে। ফলে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়। এ হার বাড়লে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের দুর্ভোগ বাড়বে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার যে ঋণ নেয় তাকে মানি প্রিন্টিং লোন বলে। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ তৈরি করতে পারে। সরকারের বিভিন্ন উপকরণ বন্ধক রেখে ঋণ দেওয়া হয়। একপর্যায়ে এসব ঋণ ট্রেজারি বিল আকারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করা হয়। তারপর এটি বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
রাজস্ব কমে যাওয়ায় গত অর্থবছরে সরকার মুদ্রিত অর্থে প্রচুর ঋণ নিয়েছে। মূল্যস্ফীতির হারও বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার সাম্প্রতিক এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বর্তমান মূল্যস্ফীতি অর্থ সরবরাহের কারণে নয়। কারণ ওই সময় অর্থ সরবরাহ কমে যায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা কমে ৭১ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আলোচ্য সময়ে স্থিতি কমেছে ৫৭ হাজার কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ছাপানো টাকায় ঋণ দেয়নি বলে এর স্থিতি কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকসহ ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণের স্থিতি গত বছরের সেপ্টেম্বরে ছিল ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ৩ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে স্থিতি বেড়েছে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণের বেশিরভাগই সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংক ও নন-ব্যাংক খাত থেকে নিয়েছে।
গত বছরের ১ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছিল ১১ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ না নিয়ে আগের ঋণ থেকে পরিশোধ করেছে ২৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
এর আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে লেখা চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া কমাতে বলেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বন্ড মার্কেট থেকে প্রতিযোগিতামূলক ভিত্তিতে ঋণ নিতে। বন্ড মার্কেটকে এখনো চাঙা করা সম্ভব হয়নি। কারণ বন্ড কেনার জটিলতায় এ মার্কেটের প্রতি বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
এদিকে, ২০২১ সালের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫.৭০ শতাংশ। ২০২২ সালের সেই মাসে এটি বেড়ে ৮.৯১ শতাংশে উন্নীত হয়। অক্টোবরে এটি আরও বেড়ে৯৯৩ শতাংশে উন্নীত হয়।
তবে ডিসেম্বরের মধ্যে এই হার ৮ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জুন নাগাদ তা ৬ শতাংশে নেমে আসতে পারে।
গত বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ১০ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। চলতি বছরের ওই সময়ে নতুন ঋণ না নিয়ে আগের ঋণ পরিশোধ করেছে ৩ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা।
গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে নেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। চলতি বছরের একই সময়ে নেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।