ফাতিমা সাহাবা নামের এক ১৯ বছর বয়সী তরুনী জানান, তার প্রিয় কোরআনের ক্যালিগ্রাফি অনুলিপি বানানোর খুব শখ ছিল। সেই লক্ষ্য পূরনের জন্য গেল বছর তিনি পবিত্র কুরআনের একটি অধ্যায়ের একটি ক্যালিগ্রাফি তৈরী করেন এবং তার বাবা-মা এবং বন্ধুদের দেখান। তারা তার নৈপূন্যতা দেখে খুব খুশি হন। তিনি সেই সময় তার ইচ্ছা পূরনের কথা বলেন। তিনি তাদের বলেন, আমি ক্যালিগ্রাফি ব্যবহার করার মাধ্যমে সমগ্র কুরআনের একটি কপি বা অনুলিপি তৈরী করতে চাই। তারা সেই কথা শোনার পর আমাকে অনেক উৎসাহ প্রদান করে। তবে তার কথা শুনে তারা বলেন, কাজটি সহজ হবে না।
কিন্তু মাত্র ১৪ মাসেই তিনি কোরআনের অনুলিপি তৈরি করে সবাইকে চমকে দিয়েছেন। শুধু আত্মীয়-স্বজনই নয়, অপরিচিতরাও তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তার সাফল্যে। ফাতিমা দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যের কান্নুর জেলায় থাকেন। ছোটবেলা থেকেই চিত্রকলা ও ক্যালিগ্রাফির প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি প্রায়ই ছবি আঁকতেন এবং তার বাবা-মাকে দেখাতেন। তারাও তাকে উৎসাহিত করেছেন।
ক্লাস নাইনে পড়ার সময় তিনি ক্যালিগ্রাফিতে বেশি মনোযোগ দিতে শুরু করেন। ‘এই বিশেষ বিদ্যার প্রতি ভালোবাসা থেকে তিনি প্রায় প্রতিদিনই ক্যালিগ্রাফি করতেন। “আমি স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়ে ছবি আঁকা শুরু করতাম,” তিনি বললেন। তিনি বলেন যে কুরআন এবং এর আয়াত সর্বদা তাকে মুগ্ধ করে থাকে। তাই তিনি সেরা ক্যালিগ্রাফি দিয়ে কুরআনের একটি অনুলিপি তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
“প্রথম দিকে একটা বা দুটো আয়াত লিখতাম,” বলছেন ফাতিমা, “মা-বাবা খুব প্রশংসা করতেন। আয়াতগুলো ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখতাম। কিছুদিন পর দেখা গেল আমার পরিচিত জনেরা সে সব ফ্রেম কিনে নিচ্ছেন। আর আমি মনের আনন্দে তাদের জন্য আঁকতে থাকলাম। এতে করে আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে। আমিও যে কিছু একটা করতে পারি, কিছু একটা আমার জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আমি এটা বিশ্বাস করতে শুরু করি।”
ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়ার সময় ফাতিমা সাহাবা তার পরিবারের সাথে ওমানে থাকতেন। এক ছোট বোন এবং এক ছোট ভাই আর মা-বাবা নিয়েই তার পরিবার। এক সময়ে তার পরিবার ভারতে ফিরে আসে। কান্নুর জেলার কোডাপারমবা শহরে তাদের বাস। স্কুল শেষ করার পর ফাতিমা কলেজে ছবি আঁকা শিখতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি ইন্টিরিয়ার ডিজাইন পড়া শুরু করেন। এখন কান্নুরের কলেজেই তিনি ইন্টিরিয়ার ডিজাইন পড়ছেন।
তিনি বলেন, ওমান থেকে ভারতে ফেরার পর প্রথম দিকে সবার সাথে মিশতে তার লজ্জা লাগতো। কিন্তু এখন তার বেশ কিছু বন্ধু তৈরি হয়েছে। ওমানের জীবন ছিল এক রকম,” বলছেন তিনি, “আর ভারতের জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ অন্য রকম। তবে এখানে মজা অনেক বেশি। এখানে আমার সব আত্মীয়-স্বজন থাকেন।”
তিনি বলছেন, সুযোগ থাকলে প্রতিটি মানুষেরই উচিত তিনি যে পেশা পছন্দ করেন তা বেছে নেয়া, এবং তার জন্য কঠোর পরিশ্রম করা। কুরআনের ক্যালিগ্রাফির কাজে হাত দেয়ার আগে ফাতিমা সাহাবার বাবা একজন মাওলানার সাথে কথা বলেন। তিনি জানতে চান, ফাতিমা কুরআন লিখতে পারেন কি না। তবে এ নিয়ে কোনো ধর্মীয় বিধিনিষেধ নেই। ফলে ফাতিমাকে অনুমতি দেয়া হয়।
“আমি বাবাকে বললাম আমাকে কালো বল পয়েন্ট কলম আর ছবি আঁকার কাগজ কিনে দিতে। কাছের একটি দোকান থেকে বাবা সব জোগাড় করলেন।
“প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে আমি একটু বিশ্রাম নিতাম। তারপর মাগরিবের নামাজ পড়ে আমি কুরআনের অনুলিপির কাজে হাত দিতাম। গত বছর অগাস্ট মাসে আমি ক্যালিগ্রাফির কাজ শুরু করি এবং ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি কুরআনের অনুলিপির কাজ শেষ করি। আমার ছোট বোন এবং ভাই রয়েছে। আমি ভাবতাম ক্যালিগ্রাফ তৈরি করার সময় তারা হয়তো আমাকে জ্বালাতন করবে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম তারা জ্বালাতন তো করছেই না, বরং নানা ভাবে আমাকে সাহায্য সহযোগিতা করছে।”
ফাতিমা জানতেন তিনি যে কাজে হাত দিয়েছেন, সেটি কত বড় এক কাজ। তাই কাজটা তিনি যেনতেনভাবে শেষ করতে চাননি। আমার ভয় ছিল যে আমি হয়তো কুরআন অনুলিপির কাজে কোনো একটা ভুল করে ফেলবো,” বলছেন তিনি, “ছবি আঁকার সময় আমার মা তাই আমার পাশে বসে থাকতেন, এবং কোথাও কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখলে সেটা ধরিয়ে দিতেন। যাতে কোনো ধরনের ভুল না হয় সে জন্য ফাতিমা প্রথমে পেন্সিল দিয়ে ক্যালিগ্রাফের নকশা তৈরি করতেন।
“যখন আমি সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হতাম যে কোথাও কোনো ভুল নেই তারপর আমি কলম দিয়ে নকশাগুলোকে পাকা করতাম। আমার শুধু মনে হতো এত বড় এবং কঠিন একটা কাজ কি আমি শেষ করতে পারবো? আমার নিজের ক্ষমতা নিয়েও মাঝে মধ্যে সন্দেহ তৈরি হতো। কিন্তু দেখা গেল প্রতিদিন কাজটা করতে গিয়ে আমি বেশ আনন্দই পাচ্ছি। ঘণ্টা পর ঘণ্টা সময় যে কোন দিক থেকে কেটে যেত তা টেরই পেতাম না।”
কুরআনের অনুলিপি তৈরি করতে গিয়ে ফাতিমা মোট ৬০৪টি পাতা তৈরি করেন। “শুরুর দিকে কাজগুলো ভালোপই ছিল। কিন্তু পরের দিকে কাজ আরও ভালো। করতে করতে হাতের কাজ আরও সুন্দর হতে থাকে,” বলছেন তিনি। মেয়ের জন্য খুবই গর্ব অনুভব করেন ফাতিমা সাহাবার বাবা-মা। তারা বলেন, খুব গর্ব হয় তাদের মেয়ের এই সাফল্যে।
মা নাদিয়া রউফ বলেন, “আল্লাহ্’র রহমতে ফাতিমা তার সব কাজ শেষ করতে পেরেছে। আমরা সবাই খুবই গর্বিত তার জন্য। সে খুবই পরিশ্রমী এক মেয়ে। সে যাই করুক খুব মন দিয়ে তা করে।” “আল্লাহ্’র কাছে হাজার শোকর গুজার যে এরকম একটি মিষ্টি আর ধর্মভীরু একটি মেয়ে তিনি আমাদের দিয়েছেন,” বলছেন ফাতিমার বাবা আব্দুর রউফ। ফাতিমা বলেন, তার স্বপ্ন পূরণের জন্য তার অভিভাবকরা কখনই পেছপা হন না। মানুষ যখন তার কাজ নিয়ে প্রশংসা করেন তখন বাবা খুবই খুশি হন। “কুরআনের অনুলিপি তৈরির ব্যাপারটি প্রথমদিকে আমি শুধু আমার মা-বাবা আর বন্ধুদেরই বলেছি। কাজ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত অন্য কাউকে এ কথা জানাতে চাইনি।”
ফাতেমা সাহাবা বলেন, তিনি সুন্দর করে ঘর আঁকতে এবং সাজাতে ভালোবাসেন। “আমি একজন ক্যালিগ্রাফি শিক্ষক হতে চাই,” তিনি এমন ইচ্ছার কথা জানান৷ তিনি যোগ করে বলেন,’ এর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। তখন আমাকে আর কেউ আটকাতে পারবে না।’ তিনি বলেছিলেন,’ছোটবেলায় তিনি বন্ধুদের হাতে মেহেদি আঁকতেন। তার বন্ধুরা তার নকশা খুব পছন্দ করতো।’
“কারণ হল, আমি যে ধরনের মেহেদি দিয়ে নকশা করতাম সেটা ছিল একেবারেই আলাদা এবং চিরাচরিত নকশার মতো না। এভাবেই আমি ক্যালিগ্রাফির বিশেষ দিকটির প্রতি আকর্ষিত হই। আরবি ভাষা ব্যাবহার করে অনেক সুন্দর সুন্দর ডিজাইন তৈরী করা যায় যেগুলো একজন শিল্পীর জন্য খুবই আকর্ষণীয়।” ফাতিমা বর্তমানে তার বেশিরভাগ সময় পড়াশুনা এবং ক্যালিগ্রাফির কাজ করার জন্য ব্যয় করেন। তিনি তার বন্ধুদেরও সময় কাটান এবং বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। তাদের সাথে সে মজা করেই সময় কাটান।
তিনি বলেন, “বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়াটা দারুণ, আনন্দের মাধ্যমে সময় কাটে। তাদের সাথে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগে, সময় কখন চলে যায় টেরই পাইনা,” সে যোগ করে।
“আমি কিছুটা লাজুক প্রকৃতির। কিন্তু এখন আমার সম্পর্কে যেভাবে আলোচনা হয়, সেটা আমার অনেক ভালো লাগে। যেটা আমাকে অনেক অনুপ্রানীত করে। আমি মনে করি যে, আমার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে এবং তার মূল্য পাচ্ছি। যখন লোকেরা আমার সম্পর্কে ভাল কথা বলে, সেই সময় আমার কী ভালো না লেগে পারে? আপনারাই বলুন।
খবর বিবিসি বাংলার।