‘বিগ ব্রাদার’ শব্দটির বেশ নেতিবাচক এবং আপত্তিকর অর্থ বহন করছে। যখন একটি বড় এবং শক্তিশালী দেশ একটি ছোট এবং দুর্বল দেশের উপর অযাচিত চাপ প্রয়োগ করে, তখন আধুনিক কূটনীতির ভাষায় তাকে ‘বিগ ব্রাদার’ বলা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের জন্য ভারতকে প্রায়শই ‘বিগ ব্রাদার’ হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এখন নয়াদিল্লির উচিত এই ‘বিগ ব্রাদার’ না হয়ে সত্যিকারের বড় ভাই হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সঠিক পরামর্শ দেয়া, যাতে তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে হেনস্থা বন্ধ করেন। হাসিনা যদি ভারতের কথা শোনেন তাহলে শুধু নিজের নয়, ভারতের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হবে। বাংলাদেশে আগামী জানুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনের ফলাফল শেখ হাসিনা এবং ভারত উভয়ের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
খালেদা জিয়ার বয়স এখন ৭৮ এবং অধ্যাপক ইউনূসের বয়স ৮৩। তাদের বাকি জীবন শান্তিতে কাটানোর অধিকার রয়েছে। শেখ হাসিনার নিজের বয়স ৭৭ বছর। তারপরও তিনি খালেদা জিয়ার জীবন নিয়ে খেলা করছেন।
চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি পাচ্ছেন না খালেদা জিয়া। আবার অধ্যাপক ইউনূস যেভাবে বিচারিক হয়রানির শিকার হচ্ছেন তাতেও তার স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়ছে।
খালেদা জিয়া দুইবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রধান। ২০২০ সাল থেকে তিনি গৃহবন্দী। গত সপ্তাহে শেখ হাসিনার সরকার লিভার ট্রান্সপ্লান্টের জন্য খালেদা জিয়াকে জার্মানিতে যাওয়ার অনুমতি প্রত্যাখ্যান করে। তার লিভার সিরোসিস, ডায়াবেটিস ও হার্টের সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশের চিকিৎসকরা প্রকাশ্যে বলছেন, বিদেশে জরুরি চিকিৎসা না নিলে খালেদা জিয়ার মৃত্যুর ‘উচ্চ ঝুঁকি’ রয়েছে। বাংলাদেশের ১৭ জন শীর্ষ চিকিৎসকের একটি প্যানেল ঘোষণা করেছে যে তাদের আর কিছু করার নেই।
শেখ হাসিনা শুধু খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতে বাধা দিচ্ছেন না, যুক্তি দিচ্ছেন যে তার বয়স এতই যে তার যে কোনো সময় মৃত্যু হতে পারে। শেখ হাসিনা সম্প্রতি লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে বলেন, রোজই শুনি এই মরে মরে, এই যায় যায়। বয়সতো ৮০’র উপরে । সময় হয়ে গেছে। তার মধ্যে অসুস্থ। এখানে এতো কান্নাকাটি করে লাভ নাই।
প্রফেসর ইউনূস বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত বাংলাদেশিদের একজন। তিনিও শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার শিকার। ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ের পর তিনি বাংলাদেশীদের কাছে নায়ক হয়ে ওঠেন। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তার যুগান্তকারী কাজ বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখছে। গরীবের ব্যাংকার হিসেবে পরিচিত প্রফেসর ইউনূস বিশেষ করে নারীদের চরম দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছেন। বাংলাদেশের বাইরেও অনেকে তাকে অনুসরণ করে। অনেক বিশ্বনেতাকে তার ব্যক্তিগত বন্ধুদের মধ্যে গণ্য করা যেতে পারে।
তবে চলতি মাসেই ঢাকায় দুর্নীতি দমন কমিশনে হাজির হতে হবে অধ্যাপক ইউনূসকে। এ জন্য তাকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে তার সফর সংক্ষিপ্ত করতে হয়েছে। ইউনূসকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ট্রাইব্যুনাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি নির্ভয়ে ঘোষণা করেন যে তিনি কাউকে ভয় পান না কারণ তিনি কোনো অপরাধ করেননি। তিনি কারও নাম বলেননি, তবে এই বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ কাকে উল্লেখ করেছিলেন তা সকলেই জানেন। ইউনূসকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য শেখ হাসিনা বহু বছর ধরে নানা কথা বলে আসছেন। প্রকাশ্যে তিনি এই নোবেল বিজয়ীকে ‘গরীবের রক্তচোষা’ বলে অপমান করেছেন। যে মামলাটিতে দুর্নীতি দমন কমিশনে তাকে উপস্থিত হতে হয়েছিল, তা তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ১৭৫টি ফৌজদারি ও শ্রম মামলার একটি। এর সবগুলো মামলাই করেছে শেখ হাসিনার সরকার কিংবা প্রশাসনের সমর্থন পাওয়া কিছু মানুষ।
অধ্যাপক ইউনূস ২০০৭ সালে একটি রাজনৈতিক দল চালু করার চেষ্টা করেছিলেন এবং তার খেসারতই এখনও তাকে দিতে হচ্ছে। সে সময় শেখ হাসিনা ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়া উভয়েই সেনা-সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের হাতে কারাগারে ছিলেন। বাংলাদেশের অন্যতম বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে, সাধারণ বাংলাদেশীরা ইউনূসকে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের আহ্বান জানান। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার শাসনামলের বিকল্প তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
অধ্যাপক ইউনূস আনুষ্ঠানিকভাবে ‘নাগরিক শক্তি’ নামে একটি দল চালু করেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে আমি আর রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারব না। এখন কিছু করার সেরা সময়। যদিও তার অবস্থা হয়েছিলো অনেকটা পানিবিহীন মাছের মতো। বিষয়টি অনুভব করে দুই মাসের মধ্যেই তিনি তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু তবুও এখনও তাকে এর খেসারত দিতে হচ্ছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী শেখ হাসিনা রাজনীতিতে আসার জন্য এবং রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিবাজ বলার জন্য ইউনূসকে ক্ষমা করেননি। ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর, তিনি চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হয়ে রেকর্ড গড়তে আগ্রহী।
ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান বিচারিক হয়রানি বন্ধে শেখ হাসিনার কাছে ইতিমধ্যেই ১৭০ টিরও বেশি বিশ্বনেতা খোলা চিঠি দিয়েছিলেন। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও বিল ক্লিনটন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন এবং শতাধিক নোবেল বিজয়ী। কিন্তু তাতেই থেমে থাকেননি শেখ হাসিনা। ইউনূসকে ফাঁসানোর অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। ইউনূসের পক্ষে লবিং বন্ধ করতেও তিনি তাকে পাঠানো চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের বলেছেন। তিনি এটাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখান। একমাত্র বিগ ব্রাদার হিসেবে একমাত্র ভারতই পারে ইউনূস ও খালেদা জিয়াকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সাহায্য করতে। এই ‘পবিত্র দায়িত্ব’ পালনের জন্য নয়াদিল্লির কোনো বিকল্প নেই।
(কলামটির লেখক- এসএনএম আবদি, যিনি একজন স্বাধীন সাংবাদিক। তিনি ভারতের পররাষ্ট্র নীতি এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করেন)