সম্প্রতি বাইডেনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সেলফি তুলাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয় দেশে। আর এ বিষয়ে নানা মন্তব্য করেন আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতারা। এখানে শেষ নয় তাদের দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের দূরত্ব কমেছে।এবার নতুন আলোচনার শুরু হয়েছে ভিসা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে।যদিও বিষয়টি নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এটি নিয়ে চিন্তার কারণ নেই।কিন্তু সরকারের শীর্ষ নেতাদের নানা মন্তব্যে দেশের মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ গোলাম মাওলা রনি হুবহু পাঠকদের জন্য নিচে দেওয়া হলো।
ইয়া গু/জবি ! ওয়া গজবি !
গুজবের সঙ্গে গজবের যে কী মিল রয়েছে তার কিছু বাস্তব উদাহরণ দেওয়ার আগে গুজব ও গজব নিয়ে দু-চার কথা বলা আবশ্যক। গুজব হলো এমন এক মিথ্যা প্রচারণা যাকে সব মিথ্যার গডফাদার বলা যেতে পারে। ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষ সাধারণত মিথ্যা বলে নিজের স্বার্থসিদ্ধি কিংবা নিজের দুর্বলতা ঢেকে রাখার জন্য। নিজেকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করে তোলার জন্যও মিথ্যা বলে থাকে। মিথ্যা বলার পাশাপাশি মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া এবং মিথ্যা প্রচারণার অভ্যাস বহু মানুষের মজ্জাগত চরিত্রে পরিণত হয়ে আসছে সেই আদিকাল থেকে।
মিথ্যার সঙ্গে গুজবের ব্যাকরণগত পার্থক্য হলো- গুজবের পরিধি, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য মিথ্যার চেয়ে ব্যাপকতর। মিথ্যাকে যদি আপনি একটি পুকুরের সঙ্গে তুলনা করেন তবে গুজবকে তুলনা করতে হবে সাগরের সঙ্গে। মিথ্যাবাদীরা সাধারণত বোকাসোকা প্রকৃতির হয়। কোনো বুদ্ধিমান মানুষ সাধারণত মিথ্যা বলেন না। কিন্তু যেসব মানুষের বুদ্ধিমত্তা চালাকির স্তর অতিক্রম করে শয়তানের পর্যায়ে চলে যায় এবং চরিত্রে মোনাফেকির বদগুণ সংযোজিত হয় ঠিক তখনই তার পক্ষে গুজব তৈরি করা সম্ভব হয়। দ্বিতীয়ত, গুজবের সঙ্গে ব্যক্তিগত স্বার্থের চেয়ে অন্যের ক্ষতি করা, সমাজ, রাষ্ট্রে অশান্তি সৃষ্টি এবং সম্মানিত মানুষের কর্মকাণ্ডে ঈর্ষা পোষণ করে তাদের বেইজ্জতি করার যে কৌশল মানুষের জবান দিয়ে বের হয় তাই গুজব। ফলে গুজব দ্বারা পরিবার-সমাজ এবং রাষ্ট্রের যে ক্ষতি হয় তা মানুষের অন্য কোনো আচরণ তো দূরের কথা-কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা রোগশোক মহামারি দ্বারাও সম্ভব নয়।
একটি দেশ-কাল-সমাজ কীভাবে চলছে তা যদি বুঝতে চান তবে সেখানকার মানুষের মিথ্যাচার ও গুজব তৈরির সর্বনাশা অভ্যাসকে মূল্যায়ন করলেই আপনি খুব সহজে বুঝতে পারবেন যে, সেখানকার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সভ্যতা কতটা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। মহাকালের ইতিহাসে গুজব যে কত ভয়ংকর পরিণতি বয়ে নিয়ে এসেছিল তার প্রথম লিখিত দলিল পাওয়া যায় পবিত্র তাওরাতে। পবিত্র বাইবেল এবং মহাগ্রন্থ আল কোরআনেও একটি ঘটনা চমৎকারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে হজরত মুসা (আ.)-এর জমানায় শক্তিশালী এবং অত্যন্ত পরাক্রান্ত সম্রাট দ্বিতীয় রামসিস যখন কোনো অবস্থাতেই আল্লাহর নবীর সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না তখন তিনি সুকৌশলে কতিপয় প্রভাবশালী এবং অতিশয় ধুরন্ধর লোককে হজরত মুসার দলে ঢুকিয়ে দেন, যাদের নেতৃত্বে ছিল কারুন নামক এক ধনাঢ্য ব্যক্তি যিনি সম্পর্কে মুসা (আ.)-এর নিকটাত্মীয় ছিলেন। কারুন ছাড়াও হারুন আস সামেরি নামক আরেক ব্যক্তি ছিলেন যাদের কারণে খোদায়ী গজব পুরো বনি ইসরাইল জাতিকে পাকড়াও করেছিল।
হজরত মুসা (আ.), কারুন ও হারুন আস সামেরির ঘটনা বর্ণনা করার আগে বাংলাদেশের হালহকিকত নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলা আবশ্যক। আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামাজিক সংহতি হাল আমলে যেভাবে ভয়ানক গুজবের পাল্লায় পড়েছে তাতে করে আমাদের জাতীয় জীবনে আসমানি গজব অনেকটা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। হজরত মুসা (আ.)-এর জমানার বণি ইসরাইলিরা গুজব শুনে নাচানাচি করত। আল্লাহর দুজন সম্মানিত নবী হজরত মুসা (আ.) এবং তাঁর ভাই হজরত হারুন (আ.)-এর বিরুদ্ধে প্রচারিত গুজবের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তারা একের পর এক অনাসৃষ্টি-অরাজকতা-বিশৃঙ্খলা ও নাফরমানি কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে নাচানাচি করত। ঠিক একই কায়দায় ২০২৩ সালের বাংলাদেশের সাড়ে সতেরো কোটি মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয় মহাকালের সবচেয়ে ভয়ানক গুজবের মহামারির কবলে পড়ে অবিরতভাবে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
হাল আমলের মানুষ আর সত্য শুনতে পছন্দ করছে না। গু/জব এখন অনেক মানুষের গলার মালা- কারও মাথার তাজ এবং কারও কারও শরীরের পোশাকে পরিণত হয়েছে। তারা গুজব না শুনে খেতে বসে না। খাওয়ার পর আবার গুজব না শুনলে অনেকের হজম হয় না। গুজব এখন বাংলার সবচেয়ে অব্যর্থ ঘুমের মহৌষধে পরিণত হয়েছে। ঘুমানোর আগে সামাজিক মাধ্যম ঘেটে ঘণ্টা দুয়েক গুজব না শুনলে বেশির ভাগ লোকের ঘুম হয় না। মানুষের স্বপ্নও ইদানীংকালে গুজবনির্ভর হয়ে পড়েছে। দিনের বেলায় যেসব গুজব শুনে তা তারা মন মস্তিষ্কে এমনভাবে ধারণ করে যে ঘুমন্ত অবস্থায় গুজব নির্মিত স্বপ্ন সুখের আবেশ নিয়ে বেশির ভাগ মানুষের ঘুম ভাঙে।
বর্তমান সমাজে গুজবকারীরাই সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। তারাই অনেকের স্বপ্নের নায়ক। এক সময় নাটক-সিনেমার নায়কদের ঘিরে যে আকর্ষণ ছিল তার চেয়েও বেশি আকর্ষণ এখন গুজব সৃষ্টিকারীদের ঘিরে আবর্তিত হয়। লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের ঘিরে মানুষের মধ্যে যে সম্মানবোধ কাজ করত তা এখন গুজবকারীদের পকেটে চলে গিয়েছে। অনেক মানুষ গুজবকারীদের জাতীয় ত্রাণকর্তা মনে করছে। তারা গুজবকারীদের জাতীয় বীর আখ্যা দিয়ে তাদের পীর-সন্ন্যাসীদের মতো তোয়াজ তদবির শুরু করেছে। নিজেদের প্রিয় জিনিসগুলোকে তারা গুজববাবাদের পায়ে সমর্পণ করার জন্য দশপায়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং কাজকর্ম ভুলে গুজবকারীর কথা শোনাকে অনেকে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বানিয়ে ফেলছে।
হাল ফ্যাশনের গুজবকারীরা সকালবেলা শেখ হাসিনার ক্ষমতা নিয়ে নিচ্ছে আবার বিকাল বেলা তা ফিরিয়ে দিচ্ছে। তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং অথবা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাগ্যও নির্ধারণ করে দিচ্ছে। তাদের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা এত বেশি বেড়েছে যার দ্বারা বাইডেন-মোদি-শির মেজাজ মর্জি নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে তাদের ব্যবহার করার ক্ষমতা হাসিল করে ফেলেছে। গুজববাবাদের এহেন কর্মকাণ্ডে আমাদের জীবনে কী কী গজব আসতে পারে তার নমুনা এবার হজরত মুসা (আ.)-এর জীবনী থেকে পেশ করব।
হজরত মুসা (আ.)-এর বিরুদ্ধে গু/জবকারীরা প্রচার করল যে, আল্লাহর নবী ব্যভিচারে জড়িত (নাউজুবিল্লাহ)। হজরত মুসা (আ.) গুজবকারীদের বিরুদ্ধে বদদোয়া দিলেন। ফলে কারুন তার ধন-সম্পদসহ মাটির মধ্যে ডুবে গেল। তার জমানার দ্বিতীয় ভয়ংকর গুজব ছিল বনু আমালিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করার জন্য নানারকম গুজব। আজকের সিরিয়া এবং লেবানন অঞ্চলে বনু আমালিকদের বসবাস ছিল। হজরত মুসা (আ.) আল্লাহর হুকুমে তাঁর অধীনস্থ বনি ইসরাইল জাতিকে সিরিয়া ও লেবাননে হিজরতের নির্দেশ দিলে গুজবকারীরা সাধারণ জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলে। তারা এসে হজরত মুসা (আ.)-কে বলতে থাকে- ‘হে মুসা। এটা কী ধরনের কথা। আমরা তো মিসরে খুব ভালো ছিলাম। তুমি ও তোমার আল্লাহর কথায় এই তিহ ময়দানে এসেছি। এখন আবার তুমি ও তোমার আল্লাহ আমাদের এমন এক দেশে যেতে বলছ সেখানে শক্তিশালী বনু আমালিকরা বসবাস করে। তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা ছাড়া ওখানে বসবাস সম্ভব নয়-আর যুদ্ধ করতে গেলে তারা আমাদের হলকুম চেপে ধরে একবার ওপরে তুলবে তারপর মাটিতে আছাড় দিয়ে মেরে ফেলবে। সুতরাং আমরা যুদ্ধ করতে পারব না। আগে তুমি এবং তোমার আল্লাহ গিয়ে যুদ্ধ কর- তারপর আমরা সেখানে যাব।
বনি ইসরাইলিদের কথায় হজরত মুসা (আ.) যারপরনাই বিরক্ত হলেন এবং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের গজব জমিনে অনিবার্য হয়ে পড়ল। বনি ইসরাইল জাতি পরবর্তী ৪০ বছর পথ হারিয়ে দিকভ্রান্ত অবস্থায় মরুভূমির মধ্যে দুর্বিষহ দিন কাটাতে বাধ্য হলো। নবী-রসুলদের জমানার বাইরে বিশ্ব রাজনীতিতে কেবল গুজবের কারণে কত রাজা-বাদশাহ-সম্রাটের যে পতন ঘটেছে কিংবা কত সমৃদ্ধ মহানগরী যে ধুলোর সঙ্গে মিশে গেছে তার উদাহরণ দিতে গেলে আর্যদের ভারত আক্রমণ এবং মহেঞ্জোদারো-হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের কাহিনি সবার আগে চলে আসবে। একইভাবে তৈমুর লংয়ের ভারত আক্রমণ এবং নাদির শাহের দিল্লি আক্রমণের নেপথ্যে মূল কারণ ছিল গুজব। চেঙ্গিস খান কর্তৃক খাওয়েরিজম ধ্বংস এবং তৎকালীন দুনিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ নগরী গুরগাঁওকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার নেপথ্যে ইয়াজুজ-মাজুজদের আগমন সংক্রান্ত গুজবই ছিল প্রধান কারণ।
অতীতের মতো বর্তমানকালে আমাদের জাতীয় জীবনে যে গুজবের নতুন অভ্যুদয় ঘটেছে তা আমাদের যে সর্বনাশা পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় আমরা এখনো খুঁজে পাইনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ শক্তিশালী পশ্চিমা দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক গুজববাবাদের কারণে রীতিমতো যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। মার্কিন ভিসানীতি, ভিসা নিষেধাজ্ঞা, ইউরোপের বাজারে জিএসপি সুবিধা বাতিলসহ ভয়ংকর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে ‘ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগারের’ পরিবর্তে আমাদের জনগণের বিরাট অংশ গুজববাবাদের কল্যাণে অধীর আগ্রহে সর্বনাশা গজবের আশায় দিনের পর দিন আকাশের দিকে চেয়ে আছে।