দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস পোশাক খাত। তৈরি পোশাক খাতে ত্রুটির কারণে অর্ডার বাতিল বা পণ্য রপ্তানি না হলে অনেক ব্যবসায়ী কম দামে কিনে দেশীয় বাজারে বিক্রি করে। অভিযোগ উঠেছে, বাতিলকৃত কিছু অর্ডারের মধ্যে ভালো মানের কাপড় দেশের বাইরে রপ্তানি হচ্ছে। এগুলো ‘নকল পণ্য’ নামে পরিচিত। সম্প্রতি এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটাকে পোশাক খাতের জন্য দুঃসংবাদ বলে মনে করছেন অনেকে।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিয়মানুযায়ী অর্ডার বাতিল বা ত্রুটিপূর্ণ পোশাক কারখানার ভেতরে ধ্বংস করতে হবে। তবে খালেক মন্ডল নামে রাজধানীর একটি মার্কেটের এক দোকানি জানান, তারা পোশাক কারখানা থেকে কম দামে বাতিল কাপড় কিনে থাকেন। এ সময় কাপড়ের গায়ে লাগানো ব্র্যান্ডের নাম ও ট্যাগগুলো মুছে ফেলা হয়, যাতে বোঝা না যায় তারা কোন কোম্পানির।
লোগো, ডিজাইন, ট্রেডমার্ক ইত্যাদির হুবহু প্রতিলিপি তৈরি করা বিশ্বব্যাপী নকলের অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি অফিস ‘ইউএসটিআর’-এর প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে নকল কাপড় রপ্তানির বিষয়টি উঠে এসেছে। আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন বা এএএফএ, আমেরিকান ব্র্যান্ডগুলির একটি সংগঠন, বাংলাদেশের নকল পণ্য সম্পর্কে ইউএসটিআরের কাছে অভিযোগ করেছে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী নকল পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি।
বিবিসির সাথে ই-মেইলে যোগাযোগ করা হলে এএএফএ বলেছে, বাংলাদেশ থেকে নকল পণ্যের চালান বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ১২টি দেশে আটক পণ্যের চালান। এমনকি বাংলাদেশ থেকে নকল পোশাক রপ্তানিও আগের বছরের তুলনায় ২০২২ সালে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। ফলে বাংলাদেশকে ওয়াচ লিস্টের শীর্ষে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। সংস্থাটি বলছে, ২০২২ সালে মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনে মাত্র ১৭টি অভিযানে ১ লাখ ৭৫ হাজার নকল পণ্য জব্দ করা হয়েছে, যার সবগুলোই বাংলাদেশে তৈরি। এই জাল পণ্যের চালান ঐতিহ্যগতভাবে সমুদ্রপথের পরিবর্তে অল্প পরিমাণে ডাক পরিষেবার মাধ্যমে পাঠানো হয়। সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হয়।
পোশাক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের নকল পণ্য তৈরির দুটি উপায় রয়েছে। প্রথমত, কেউ স্থানীয় বাজার থেকে সংগ্রহ করে কুরিয়ারের মাধ্যমে বিদেশে পাঠাতে পারে। দ্বিতীয়ত, কেউ হয়তো বিদেশি ব্র্যান্ডের লোগো বা ডিজাইন কপি করে পোশাক তৈরি করে রপ্তানি করছে।
তবে বিজিএমইএ তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো কারখানা থেকে নকল পণ্য রপ্তানির অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বিজিএমইএর পরিচালক ফয়সাল সামাদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি ‘ইউএসটিআর’-এর কার্যালয় এক সপ্তাহ আগে পোশাক মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। তারা নকল পণ্য রপ্তানির অভিযোগ করেনি। এর বাইরে ব্র্যান্ডগুলো থেকে নকল পণ্য রপ্তানির অভিযোগ আসলে অনুমান নির্ভর। তারা কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি বা বলতে পারেনি কারা এগুলো তৈরি করছে।
ফয়সাল সামাদ বলেন, এটা মোটেও বেআইনি নয়। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাথে যে কারখানাগুলি লেনদেন করে তারা নিয়মিত এটি করে। এখন ধরুন একটি আদেশ বাতিল করা হয়েছে। এখন তাদের অনুমতি নিয়ে ব্র্যান্ডের লেবেল সরিয়ে বাইরে বিক্রি করা যাবে। এটা বেআইনি নয়। এখান থেকে দু-একজন হতে পারে, যারা সঠিক নিয়ম মেনে বের হয়নি। তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে কেউ নকল পণ্য তৈরি করলে তার দায় বিজিএমইএর নয়। কারণ, তারা এই সংস্থার অধীনে নয়।
নকল পণ্যের বিষয়টি প্রমাণিত হলে পোশাক খাতের জন্য ভালো হবে না বলে স্বীকার করেন ফয়সাল সামাদ। তিনি বলেন, নকল কাপড় রপ্তানির বিষয়টি প্রমাণিত হলে কাপড় রপ্তানিতে ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। পোশাক রপ্তানি শুল্ক বা বিধিনিষেধ সাপেক্ষে হতে পারে। ফলে সরকারকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব দেশের বাইরে থাকায় তাদের বক্তব্য নিতে পারেনি বিবিসি বাংলা। মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুক্ত অন্য কর্মকর্তারা মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে চলতি বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম বাংলাদেশকে নকল পণ্য রপ্তানির অভিযোগ আনলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও বিজিএমইএর মতো কথা বলে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন যে নকল বিদেশী ব্র্যান্ডের পোশাক বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে সহজলভ্য এবং প্রকাশ্যে বিক্রি হয়। তাই স্থানীয় বাজারে যেসব পণ্য তৈরি হচ্ছে সেগুলো দুবাই হয়ে বিভিন্ন বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, এ নিয়ে উদ্বেগ অব্যাহত থাকলে হয়তো ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশের যেকোনো পণ্যের জন্য রপ্তানি পর্যায়ে নানা শর্ত আরোপ করা হতে পারে। অথবা সেসব দেশে প্রবেশের সময় চেক করতে বিলম্ব হতে পারে। আর নকল পণ্যের রপ্তানি যদি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরিমাণের দিক থেকে বড় হয়, তাহলে কোটা আরোপ, অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ- এ ধরনের বিষয় যোগ করা যেতে পারে।’