রাজশাহীর চারঘাট থানার ওসি মাহবুবুল আলমের একটি অডিও রেকর্ডিং ফাঁস হয়েছে। যেখানে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘‘নির্বাচন করতে মন্ত্রী (পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী) আমাকে গাইবান্ধা থেকে চারঘাট থানায় নিয়ে এসেছেন।’ সেই অডিওতে পুলিশের অভ্যন্তরে অনেক চাঞ্চল্যকর বিষয়ও প্রকাশ পেয়েছে। এদিকে অডিও ফাঁস হওয়ার পর ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৬ মাস আগে চারঘাটের চামটা গ্রাম থেকে আব্দুল আলীম কালু নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। কালু মা”দক ব্যবসায়ী এমন দাবি করা হয়, মামলার প্রক্রিয়া শেষে তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে তিনি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি রয়েছেন। তবে কালুর পরিবারের দাবি, মামলাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক।
তার স্ত্রী সাহারা বেগম জানান, গত ইউপি নির্বাচনে চারঘাটের শলুয়া ইউপি’র ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য পদে ভোট করেছিলেন আমার স্বামী। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় একটি পক্ষের সঙ্গে আমার স্বামীর বিরোধ হয়। ওই প্রতিপক্ষ ডিবি পরিদর্শক আতিকুর রেজা সরকারকে ম্যানেজ করে স্বামীকে মাদকের সাজানো মামলায় গ্রেপ্তার করিয়েছেন। তার দাবি, তার স্বামীকে ডিবি পুলিশ ফাঁসিয়েছে।
এসব দাবি করে কালুর স্ত্রী অডিও রেকর্ডিংসহ জেলা পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। আর অডিওটি পুলিশের আইজি ও রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজিকেও ডাকযোগে পাঠানো হয়েছে।
৬ মিনিট ৫৩ সেকেন্ডের ওই অডিওতে ওসি মাহবুবের কন্ঠে শোনা যায়, ৭ লাখ টাকা ঘুষ দিলে মা”দক ব্যবসার অনুমতি দেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, ১৩ সেপ্টেম্বর ওসি তাকে থানা কম্পাউন্ডে তার বেডরুমে ডেকে নিয়ে সাহারা বেগমের কাছে ৭ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। ওসি বললেন, ‘এখনো তোমার গায়ে আমি আঁচড় দেইনি। বহুত ফাঁকি দিয়েছো। কালকে ৫ লাখ টাকা নিয়ে আসবা। এখন সে রকম সময় নয় যে কেউ পয়সা খায় না। সবাই পয়সা খাচ্ছে। এমন কেউ বাদ নেই যে পয়সা খাচ্ছে না। পুরো জেলা পয়সা খাচ্ছে। এখানে আমার থানা চালাতে মাসিক অনেক টাকা লাগছে। আমি স্যারকে কথা দিয়ে এসেছি। স্যারকে বলেছি, এখানে মাদক ছাড়া টাকার আর কোনো উৎস নেই।’
ওসি গৃহবধূ সাহারা বেগমকে বলেন, তোমার স্বামী আমার অনেক ক্ষতি করে জেলে গেছে (এসপি অফিসে ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে কালু) এখন তোমার পরিবারের কাউকে ধরলে আমি ছাড়তে পারব না। ১০ লাখ টাকার কমে ছাড়তে পারবো না। মুক্তার বিরুদ্ধে (চারঘাটের মাদক সম্রাট ও নারীর প্রতিপক্ষ) এখন অ্যাকশন নিতে পারবো না, শুভ’র বিরুদ্ধেও (ছাত্রলীগ নেতা ও মাদক কারবারি) অ্যাকশন নিতে পারবো না। আপনি কি ৫ লাখ টাকা দিতে পারবেন? নইলে আমি তাদের চালান দেব। থাকি না থাকি ওদের সাইজ করবো আমি। তোমরা এলাকার বাইরে থেকে মাদক ব্যবসা করবে। কোনো সমস্যা নেই।’
অডিওতে ওসিকে গৃহবধূ সাহারা বেগমের ‘সুন্দর চেহারা’ নিয়ে মন্তব্য করতেও শোনা যায়। একপর্যায়ে ওসি মাহবুবুল আলম বলেন, নির্বাচনের জন্য মন্ত্রী আমাকে গাইবান্ধা থেকে চারঘাট থানায় নিয়ে এসেছেন। আমি তাকে ছাড়া আর কারো কথা শুনি না।’ তার অডিও ফাঁসের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হয়। বিশ্লেষকদের মতে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জনগণের ভোটাধিকার হরণ করতে সরকার ‘নীল পরিকল্পনা’ এঁকেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এখন থেকে থানাগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এমনটাই জানা গেছে চারঘাট থানার ওসির কথোপকথনে।
এদিকে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ওসি মাহবুবের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ঘুষ আদায়ের জন্য সাধারণ মানুষকে হয়রানি করত। এ কাজে ডিবি পুলিশও জড়িত। একদিকে বড় বড় মা”দক ব্যবসায়ীরা টাকা হাতিয়ে অবাধ পরিবেশে মাদক ব্যবসা করতো, আবার কারো কাছ থেকে টাকা না পেলে মামলা দিয়ে গ্রেফতার করতো। কিছু মা”দক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদাবাজির অভিযোগও রয়েছে। অভিযোগের বিষয়ে ওসি মাহবুবুল আলম বলেন, আমার কাছেও অডিওটা এসেছে।
কিন্তু আমি জানি না এটা কোথায় কিভাবে এলো, এর বেশি কিছু বলতে পারছি না। তবে অডিও ফাঁসের পর তাকে চারঘাট থানা থেকে প্রত্যাহার করে রাজশাহী পুলিশ লাইনসে সংযুক্ত করা হয়। রোববার সকালে রাজশাহী জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. রফিকুল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, ঘটনা তদন্তে ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে দ্রুত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে রাজশাহী-৬ আসনের (বাঘা-চারঘাট) সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।