নোবেল পুরস্কার পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার। এই পুরস্কার দেয়া হয় ৬ টি ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য। এবার এই নোবেল পুরস্কারের আদলে প্রবর্তিত হলো ‘আর্থশর্ট’ পুরস্কার। এই পুরস্কারটি প্রবর্তন করলেন ব্রিটিশ রাজপরিবারের উত্তরাধিকারী প্রিন্স উইলিয়াম। পৃথিবীর জলবায়ু সংকট নিরসনে এবং জলবায়ু সংক্রান্ত বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এবং পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষায় কার্যকরী নতুন ধারণা প্রদান এবং সে লক্ষ্যে কোন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের বিষয়কে বিবেচনায় রেখে এই পুরস্কার প্রদান করা হবে। নোবেল পুরস্কারে যেমন ৬ টি বিভাগে পুরস্কার দেওয়া হয় এই পুরষ্কারের বেলায়ও ভিন্ন ভিন্ন বিভাগে ৫ টি ক্ষেত্রে পুরস্কার প্রদান করা হবে। এক কথায় প্রকৃতি এবং বিশ্বের জলবায়ু রক্ষায় অবদানের জন্য এই পুরস্কার প্রদান করা হবে।
ক্যাটাগরিগুলো হচ্ছে-প্রকৃতি সুরক্ষাবিষয়ক প্রোটেক্ট অ্যান্ড রেসটোর ন্যাটার, পরিষ্কার বায়ুবিষয়ক ক্লিন আওয়ার এয়ার, মহাসাগরবিষয়ক রিভাইভ আওয়ার ওসানস, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক বিল্ড আ ওয়েস্ট-ফ্রি ওয়ার্ল্ড ও জলবায়ুবিষয়ক ফ্রিক্স আওয়ার ক্লাইমেট। রোববার প্রথমবারের মতো পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। প্রত্যেক বিজয়ীকে দেওয়া হবে ১০ লাখ পাউন্ড। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১১ কোটি ৭৬ লাখ টাকারও বেশি। দ্য গার্ডিয়ান। পুরস্কার ঘোষণার জন্য উত্তর লন্ডনের আলেক্সান্দ্রা প্রাসাদে রোববার রাতে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পরিবেশকর্মীদের পাশাপাশি অনুষ্ঠানে অংশ নেন এমা ওয়াটসন, ডেম এমা থম্পসন এবং ডেভিড ওয়েলোয়োর মতো অভিনয় তারকারা।
মজার ব্যাপারে হচ্ছে, এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে কেউই বিমানে চড়েননি। মঞ্চ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়নি কোনো প্লাস্টিক। অতিথিদের পোশাক নির্বাচনে পরিবেশকে বিবেচনায় নেওয়ার অনুরোধ করা হয়। রাজকীয় ও জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্যে পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন প্রিন্স উইলিয়াম। এ সময় তার সঙ্গেই ছিলেন স্ত্রী কেট মিডলটন। এক ভিডিও বার্তায় উইলিয়াম বলেন, ‘মানব ইতিহাসের এক তাৎপর্যপূর্ণ সময়ে আমরা বেঁচে আছি। এখন থেকে ১০ বছর আমাদের প্রতিটি কর্মকাণ্ড আগামী হাজার বছর আমাদের এই পৃথিবীর ভাগ্য নির্ধারণ করবে।’
মূলত ষাটের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের চন্দ্রজয়ের প্রকল্প ‘মুনশট’ থেকে আর্থশট পুরস্কারের ধারণাটি নিয়েছেন উইলিয়াম। ওই সময় পরবর্তী এক দশকের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠানোর প্রকল্প ঘোষণা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। মূলত গত বছর পুরস্কারটি উদ্বোধন করেন উইলিয়াম। জানান, এখন থেকে আগামী এক দশক অর্থাৎ ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর পাঁচ ক্যাটাগরিতে পাঁচজনকে এই পুরস্কার দেওয়া হবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, এবার প্রথমবারের মতো পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ১৫টি প্রজেক্টের একটি শর্টলিস্ট থেকে পুরস্কারপ্রাপ্তদের নির্বাচন করেন বিচারকরা। বিচারকদের মধ্যে ছিলেন-প্রকৃতি বিশেষজ্ঞ ও উপস্থাপক স্যার ডেভিড অ্যাটেনবোরো, অভিনেত্রী কেট ব্লানচেট এবং গায়ক সারিকা। প্রকৃতি রক্ষা বা প্রটেক্ট অ্যান্ড রিস্টোর ন্যাচার বিভাগে পুরস্কার জিতে নিয়েছে আফ্রিকার দেশ রিপাবলিক অব কোস্টারিকা। বন ধ্বং’/সের ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের দশকে দেশটির অধিকাংশ বনভূমি একসময় ধ্বং’/স হয়ে যায়। তবে সম্প্রতি দেশটিতে সাধারণ জনগণ ও সরকারের পরিবেশ বিভাগের প্রচেষ্টায় গাছের সংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে রক্ষা পেয়েছে পরিবেশ, প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্র। এই প্রকল্পকে অন্যদের জন্য অনুকরণীয় মডেল বিবেচনা করা হচ্ছে।
‘বর্জ্যমুক্ত পৃথিবী গড়ি’ বা বিল্ড আ ওয়েস্ট-ফ্রি ওয়ার্ল্ড বিভাগে আর্থশট পুরস্কার জিতেছে ইতালির মিলান শহরের খাদ্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। অব্যবহৃত খাবার সংগ্রহ ও সেগুলো যাদের প্রয়োজন তাদের সরবরাহের ব্যবস্থা করায় এই পুরস্কার পেয়েছে তারা। এই উদ্যোগে নাটকীয়ভাবে বর্জ্য কমে গেছে আর একই সঙ্গে ক্ষুধা নিরসনও সম্ভব হচ্ছে। ক্লিন আওয়ার এয়ার বিভাগে পুরস্কার পেয়েছে তাকাচার নামে ভারতের একটি সামাজিক উদ্যোগ। বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১২০ বিলিয়ন কৃষিবর্জ্য তৈরি হয়। কৃষকরা এগুলো বিক্রি করতে পারেন না। ফলে এগুলো তাদের পু’/ড়িয়ে ফেলতে হয়, যা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ভ’/য়া’ব/হ পরিণতি ডেকে আনে। কৃষিবর্জ্য পু’/ড়িয়ে না ফেলে কীভাবে অন্যভাবে ব্যবহার করা যায়, সেই উপায়ই উদ্বাবন করেছেন বিদ্যুৎ মোহন নামের এক যুবক। তিনি তাকাচার নামে বহনযোগ্য এমন একটি মেশিন তৈরি করেছেন, যা কৃষিবর্জ্যকে জ্বালানি ও জৈব সারে পরিণত করে।
রিভাইব আওয়ার ওসানস বিভাগে পুরস্কার পেয়েছে বাহামার দুই বন্ধু স্যাম টেইচার ও গেটর হালপার্ন। সামুদ্রিক কোরাল বা প্রবাল উৎপাদনের একটি প্রজেক্ট গড়ে তুলেছেন তারা। বিশ্বের মৃ’/তপ্রায় কোরাল রিফ পুনরুদ্ধারে এই প্রজেক্টটির নকশা করা হয়েছে। বিশেষ ট্যাংক ব্যবহারের মাধ্যমে তারা এমন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন যাতে প্রাকৃতিক পরিবেশের চেয়ে কোরাল ৫০ গুণ দ্রুত বাড়ে। সবশেষ ফিক্স আওয়ার ক্লাইমেট বিভাগে আর্থশট পুরস্কার জিতেছে এইএম ইলেকট্রোলাইসার নামের একটি যন্ত্র। মূলত নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে পানির অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন ভেঙে হাইড্রোজেন উৎপাদনের যন্ত্র এটি। হাইড্রোজেন একটি পরিবেশসম্মত গ্যাস। তবে এটি সাধারণত জীবাশ্ম জ্বালানি পু’/ড়িয়ে তৈরি করা হয়।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে লক্ষণগুলো দেখা যাচ্ছে তা অদূর ভবিষ্যতের ভ’/য়া’ন’/ক পরিণতিরই লক্ষন। এখনই বিশ্বের ধনী দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে বিশ্বের জলবায়ু রক্ষায়। সেই সাথে পরিবেশ দূষণ রো’ধে এখনই কাজ শুরু করতে হবে গবেষক, বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদদের। সাম্প্রতিক সময়ে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হচ্ছে, তা পরিবেশ দূষণের কারণে হচ্ছে। তবে বিষয়টিকে সাধারণ মানুষ ধরতে না পারলেও বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের কাছে এটি স্পষ্ট। তারা গত কয়েক বছরের জলবায়ুর যে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন, তা নিয়ে উ’দ্বে/গ প্রকাশ করেছেন। তার মধ্যে একটি অন্যতম বিষয় হল বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি। যেটা ইতিমধ্যে বিশ্বের প্রকৃতির উপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।