Sunday , November 24 2024
Breaking News
Home / Countrywide / নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে ঈমানের পরীক্ষায় পাস করলেই তো আউয়াল কমিশন

নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে ঈমানের পরীক্ষায় পাস করলেই তো আউয়াল কমিশন

আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন। যার ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক দলগুলোসহ বিভিন্ন ব্যক্তিদের সাথে বৈঠক করছে নির্বাচন কমিশন। এতে নির্বাচন পদ্ধতিসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন তাদের সঙ্গে এবং তাদের মতামত নেন। তবে নির্বাচনে ইভিএমে নিয়ে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধীতা করে। কিন্তু কারর কোনো কথার গুরুত্ব না দিয়ে হঠাৎ ইভিএমে ১৫০ আসনে ভোট নেয়ার সিদ্ধান্তে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে নির্বাচন কমিশন। প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন এবং সংবিধান ও আইনের অধীন হবেন। কিন্তু আমাদের নির্বাচন কমিশন তাদের মেরুদণ্ড ধনুকের মতো বক্র করে সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারের প্রতি তাদের অনুগত কর্মকাণ্ডে মনে হয়, নিজেদের বিবেক পর্যন্ত সরকারের কাছে বন্ধক রাখা আছে। যার কারণে সংবিধান যে তাদেরকে কর্মের স্বাধীনতা দিয়েছে তা তারা বেমালুম ভুলে যায়। নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড এবং তাদের কর্মপরিকল্পনার সিদ্ধান্ত দেখে মনে হয় তারা সংবিধানের কাছে নয় বরং সরকারের কাছে দায়বদ্ধ। জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচন কমিশনের ভ‚মিকা কম নয়। নির্বাচন কমিশন যদি বিবেক দ্বারা চালিত না হয়ে কারো দাসত্ব ও বশ্যতার শিকারে পরিণত হয় তাহলে জনগণ একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন থেকে বঞ্চিত হবে। কাজেই নির্বাচন কমিশনাররা নির্বাচন কমিশনকে কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে জিম্মি না রেখে স্বীয় বিবেক দ্বারা সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে পারে, যে নির্বাচনে জনগণের মতের প্রতিফলন ঘটবে।

নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করে। সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সাংবাদিক, পত্রিকা সম্পাদকসহ বিভিন্ন মহলের সঙ্গে সংলাপ হয়। সংলাপে অংশগ্রহণকারীরা অধিকাংশই নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার পক্ষে ছিলেন। এমনকি সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজেই সংলাপে বলেছেন, ‘বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করে না। শুধু সরকারি দল ও সমমনা কয়েকটি রাজনৈতিক দল ইভিএমের পক্ষে কথা বলেছে। এটি মোট অংশগ্রহণকারীদের পাঁচ শতাংশের বেশি নাও হতে পারে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত উপেক্ষা করে মাত্র কয়েকটি অংশের অর্থাৎ সরকারি দলের ইচ্ছাকে অগ্রাধিকার দেয় এবং তাদের সিদ্ধান্ত দেয় যে ১৫০টি আসনে ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন হবে। সেটাই যদি সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে সংলাপের প্রয়োজন কী ছিল? যেখানে নির্বাচন কমিশন নিজেই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে উপেক্ষা করতে পারে, সেখানে সরকারের নির্দেশনা ছাড়া তারা কীভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারবে?

রকীব উদ্দীন, নুরুল হুদা ও আউয়াল কমিশনের বাগাড়ম্বর কারো থেকে কারোটা কম নয়। প্রথম প্রথম তাদের বাগাড়ম্বর দেখে মনে হয় তারা সুন্দরবনের সবচেয়ে শক্তিশালী রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তারা কোনো কিছুকেই পরোয়া করে না। তাদের হুমকি-ধমকি দেখে মনে হয় কোনো শক্তিই তাদেরকে সুষ্ঠু ভোট করতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু সময় যখন ঘনিয়ে আসে তাদের দাসত্ব স্বীকারের চমৎকৃত ভাব দেখে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা উঠে যায়। কমিশন সচিব অশোক কুমারের ভাষ্য অনুযায়ী, ইসির হাতে থাকা দেড় লাখ ইভিএম দিয়ে ৭০-৭৫টি আসনে ভোট নেয়া সম্ভব। তাহলে তারা ৭০-৭৫টি না বলে ১৫০টি আসনের কথা কেন বলল? তারা সরকারের পথ পরিষ্কার করার জন্য সরকারের শেখানো বুলিই নিজেদের মুখে প্রকাশ করেছে মাত্র। অর্থাৎ বেশি আসনে ভোট করতে আরো এভিএম কিনবেন।

সে জন্য নতুন প্রকল্পও নেওয়া হবে। এতে নির্বাচন কমিশনের লাভ হবে দু’টি- এক. কমিশন বাণিজ্যও হবে; দুই. সরকারকেও খুশি রেখে নিজেদের আখের গুছানো হবে। ভবিষ্যতে আরামের বিছানায় শুয়ে সুখের নিদ্রা যাপনের জন্য এর থেকে ভালো পন্থা আর কী আছে। এর জন্য ধনুকের মতো কেন প্রয়োজনে আরেকটু বাঁকিয়ে হলেও সরকারের পায়ে প্রণাম করলে দোষ কোথায়?

নিনির্বাচন কমিশন অবসর জীবনে সুখনিদ্রার স্বপ্নে বিভোর থাকলেও ইভিএমে ভোট দিতে দেশের মানুষ এখনো প্রস্তুত নয়। ইভিএম নিয়ে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। ইভিএমের ধীর গতি এবং কুমিল্লা নির্বাচনে প্রচণ্ড প্রতিযোগিতাও প্রমাণ করেছে ইভিএম কতটা বিপজ্জনক। দু’জন প্রার্থীর তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ওই নির্বাচনে ১০৫টি কেন্দ্রের মধ্যে ১০১টি কেন্দ্রের ফলাফলে ৬২৯ ভোটে এগিয়ে থাকা প্রার্থী শেষ চারটি কেন্দ্রের ভোটে যে নাটকীয়তায় ৩৪৩ ভোটে হেরে গেছেন, তাতে ইভিএমের গ্রহণযোগ্যতা জনগণের কাছে শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। কুমিল্লা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২৭ জুন ২০২২ তারিখে প্রথম আলোয় ড. বদিউল আলমের লেখার শিরোনাম ‘কুমিল্লায় কেউই জেতেনি, হেরেছে নির্বাচন কমিশন’ বাক্যটিই উপযুক্ত হয়েছে। জনসিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন কমিশন শুধু সরকারকে খুশি করতে গিয়ে ইভিএম ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা জনগণের সাথে প্রতারণা বৈ অন্য কিছু নয়।

এই সিদ্ধান্ত দিয়ে নির্বাচন কমিশন প্রমাণ করেছে যে, তারা সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে ক্ষমতার ব্যাপ্তি সম্পর্কে অবগত নয় বা উপলব্ধি করতে পারছে না। আমাদের নির্বাচন কমিশন অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৯ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার-তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত থাকিবে।’

সংবিধানে নির্বাচন কমিশনকে চারটি সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা প্রায় নিরঙ্কুশ এবং যেখানে আইন অসম্পূর্ণ সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে কমিশন নির্দেশনা জারি করে অসম্পূর্ণতা দূর করতে পারে। সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে কমিশনকে সুস্পষ্টভাবে ফলাফল ঘোষণার পরও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।এত ক্ষমতা পাওয়ার পরেও নির্বাচন কমিশন সরকারের প্রতি যে পরিমাণ নতজানু তা দেখে মনে হয় তারা সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়েই এই পদে এসেছেন।

তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল শপথ নেওয়ার পর ‘আগামী নির্বাচনে আইনের মধ্যে সেরা কাজ করার’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘একটি সমঝোতা’ করার অনুরোধ করবেন। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার কথাও বলেন তিনি। কিন্তু কমিশনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার অনুরোধ করার সাহস পাননি তিনি। অথচ জনগণ মনে করে একটি দন্তবিহীন নয়; দন্তযুক্ত নির্বাচন কমিশনের পক্ষেই বর্তমান অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে। কিন্তু রকীব উদ্দীন কমিশন থেকে শুরু করে নুরুল হুদা কমিশন এবং বর্তমান কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের অবস্থাও দন্তহীন বাঘের মত। রকীব উদ্দীন এবং নুরুল হুদা কমিশন নির্বাচনী সংস্কৃতি বলতে যা বুঝায় তা ধ্বংস করে গেলেও তারা তা স্বীকার না করে বরং তারা সফলতার জয়গান গেয়েছেন।
তবে রাষ্ট্রের সব মহলের জনগণের অভিমত, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, রকিব উদ্দিন ও নুরুল হুদা কমিশন তা ধ্বংস করেছে। তবে রকিব উদ্দিন ওই সময় বলেছিলেন, তাদের কোনো ব্যর্থতা নেই।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনে যে ক্যান্সারের বীজ বপন করা হয়েছিল, তা এখন পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। যার কারণে নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টিভঙ্গি দেখলে মনে হয়, আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো দল নির্বাচনে অংশ নিলো কি না তাতে নির্বাচন কমিশনের কিছু যায় আসে না। তাদের এজেন্ডা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ নির্বাচনে এসে খালি মাঠে গোল দিতে পারলেই তারা শতভাগ সফলতা ঢেঁকুর তুলতে পারবে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ‘আগামী নির্বাচনে আইনের মধ্যে থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করার’ যে অঙ্গীকার করেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘সমঝোতা সৃষ্টির’ অনুরোধ করার যে কথা বলেছিলেন, এখন সেই সুর পাল্টে ফেলেছেন। এখন নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য হলো, কমিশন কোনো দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করতে পারে না এবং সে ধরনের কোনো প্রয়াসও নেবে না। এর মানে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে সংলাপ বর্জনকারী দলগুলোর ওপর দায় চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন। সব মিলিয়ে বলতেই হয়, ক্ষমতাসীন দল ও সরকারকে স্বস্তি দেয়ার সব ব্যবস্থা করে দেয়ার অঙ্গীকার কমিশনের মাথায় আছে।

পরিশেষে বলতে চাই, সরকার নিজেই নির্বাচন কমিশনারদের বাছাই করে নিয়োগ দিয়েছেন। তারা খাঁটি নাকি ভেজাল আছে তা কষ্টিপাথরে যাচাই করেই তাদের শপথের ব্যবস্থা করেছেন। সুতরাং তারা তাদের খাঁটিত্বের পরিচয় নিয়োগকর্তাকে দেবেন এটাই তো ঈমানদারিত্ব। জনগণের ভোটাধিকার রসাতলে যাক, নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে ঈমানের পরীক্ষায় পাস করলেই তো আউয়াল কমিশন, রকীব উদ্দীন এবং নুরুল হুদা কমিশনের মতো শতভাগ সফলতার ঢেঁকুর তুলে জয়গান গাইতে পারবে।

প্রসঙ্গত, নির্বাচন কমিশন সরকারের কথার বাহিরে যাওয়ার মত কোনো ক্ষমতা রাখে না্ তার বাস্তব প্রমাণ তারা তাদের কাজ দিয়ে প্রকাশ করছে। প্রশ্ন নির্বাচন আদৌ কি নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে চায় নাকি বিগত দুটি নির্বাচন কমিশনের পথেই হাটতে চায়।

About Babu

Check Also

পদ্মা সেতুতে শেখ হাসিনাকে নিয়ে সারজিস আলমের ব্যঙ্গাত্মক পোস্ট ভাইরাল

২০২২ সালে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পদ্মা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *