Saturday , November 23 2024
Breaking News
Home / Countrywide / ৩৫ বছরের শিক্ষকতায় একদিনও ছুটি নেননি সত্যজিত, স্কুলে পৌঁছতে দেরিও করেননি কখনো

৩৫ বছরের শিক্ষকতায় একদিনও ছুটি নেননি সত্যজিত, স্কুলে পৌঁছতে দেরিও করেননি কখনো

ঘটনাটি অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, বাস্তবে এমনই একটি নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দিয়েছেন অভয়নগরের সত্যজিত বিশ্বাস। জানা যায়, দীর্ঘ ৩৫টি বছর ধরে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। কিন্তু ১ দিনের জন্যও স্কুলে দেরি করে আসেননি । এমনকি তিনি একদিনও ছুটিও নেননি। প্রতিদিন ঘন্টা বাজার আগেই স্কুলে চলে যেতেন সত্যজিত। আর এজন্য অনেক সময় স্ত্রীর বকা-ঝকাও শুনতে হয়েছে তাকে।

আগামী ৯ অক্টোবর অবসরে যাচ্ছেন ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সত্যজিৎ বিশ্বাস।

সত্যজিৎ বিশ্বাসের বাড়ি যশোরের মণিরামপুরের কুচলিয়া গ্রামে। শিক্ষকতা করেন জেলার অভয়নগরের ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। পড়ান নবম ও দশম শ্রেণির গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞান। শিক্ষকতা করছেন ৩৫ বছর ধরে। এতগুলো বছরে এক দিনও অনুপস্থিত থাকেননি কর্মস্থলে। ঝড়-বাদল কিংবা অসুস্থতা প্রতিবন্ধক হতে পারেনি তাঁর পথে; এমনকি নিজের বিয়ে কিংবা বাবার মৃত্যুও না। এ জন্য জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে ডজনের বেশি পুরস্কার পেয়েছেন। জয় করেছেন অসংখ্য শিক্ষার্থীর মন। গুণী মানুষটির কর্মজীবনের সমাপ্তি ঘটছে আগামী ৯ অক্টোবর। তিনি বিদ্যালয়ে থাকছেন না—এমনটি ভাবতেই পারছে না শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের ছেড়ে অবসর কিভাবে কাটাবেন, ভেবে পাচ্ছেন না সত্যজিৎ নিজেও।

১৯৮৪ সালে বিএসসি পাস করেছিলেন সত্যজিৎ। ১৯৮৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। এর পর থেকে এক দিনও কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকেননি; এমনকি বিয়েটাও করেছিলেন ছুটির দিন—শুক্রবারে। ১৯৯০ সালে। পাত্রী নড়াইলের পঁচিশা গ্রামের আরতী বিশ্বাস। নববধূকে রেখে শনিবার সকালে ২০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে সময়মতো স্কুলে পৌঁছে যান। বিকেলে ছুটির পর আবার ২০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছেন। ১৯৯৩ সালে এক সোমবার সকালে মারা যান তাঁর বাবা মাধবচন্দ্র বিশ্বাস। সত্যজিৎ চাকরির শুরুতে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কখনো স্কুল ফাঁকি দেবেন না। তখন পাড়ার লোকজন ডেকে তিনি নিজের প্রতিজ্ঞার কথা বলেন। এরপর যোগ দেন ক্লাসে। বিকেলে স্কুল ছুটির পর বাবার সৎকার করেন।

পদন্নোতি পেয়ে ২০১৫ সালে সহকারী প্রধান শিক্ষক হন সত্যজিৎ। তখনো নিয়মিত নবম-দশম শ্রেণির গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞান পড়াতেন।

kalerkanthoব্যক্তিজীবনে দুই সন্তানের জনক। ছেলে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে স্নাতকোত্তর। মেয়ে পশুপালনের ওপর স্নাতকোত্তর করছেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্ত্রী আরতী বিশ্বাস গৃহিণী। ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে পাওয়া গেল সত্যজিৎ বিশ্বাসকে। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বললেন, ‘কর্মজীবনে যোগ দেওয়ার সময় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম—জীবনে কোনো দিন স্কুল ফাঁকি দেব না। বিধাতা আমাকে এই কাজে সাহায্য করেছেন। বড় ধরনের অসুখও হয়নি। সব সময় ঠিকমতো হাজির হয়েছি স্কুলে। চাকরিজীবনে দুদিন স্কুলে পৌঁছানোর পর কিছুটা অসুস্থ বোধ করি। একদিন ক্লাস শুরুর আগে সমাবেশ চলা অবস্থায় মাথা ঘুরে পড়ে যাই। সবাই মিলে আমাকে ধরে অফিস কক্ষে নিয়ে মাথায় পানি দেন। এরপরই সুস্থ হয়ে যাই। ছোটবেলা থেকে আমি এমন। গ্রামের দিগঙ্গা কুচলিয়া হরিদাসকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। স্কুলজীবনে অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে কোনো দিন অনুপস্থিত থাকিনি। অসুস্থতার জন্য দশম শ্রেণিতে দুই দিন অনুপস্থিত ছিলাম।’ জানতে চাইলাম, এমন কোনো দিনের কথা মনে পড়ে, যেদিন স্কুলে পৌঁছতে খুব কষ্ট হয়েছিল? ‘আমার বাড়িটি অপেক্ষাকৃত নিম্নাঞ্চলে। স্কুলে যাওয়ার পথে অনেক দিনই কষ্ট হয়। বছর দশেক আগের কথা। মণিরামপুর-নওয়াপাড়া সড়কের ধোপাদী বটতলা থেকে সোড়াডাঙ্গা পর্যন্ত বন্যার পানিতে ডুবে গিয়েছিল। জায়গাটা সাঁতরে পার হয়েছিলাম। তার পরও ঠিক সময় স্কুলে পৌঁছতে পেরেছিলাম’, বলছিলেন সত্যজিৎ বিশ্বাস।

অবসরজীবন কিভাবে কাটাবেন—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘স্কুল নিয়ে এত মেতে ছিলাম যে গ্রামের মানুষ ঠিকই আমার নাম জানে, হয়তো অনেকে আমার মুখ চেনে না। এবার এলাকাবাসীকে সময় দেবো। মণিরামপুর উপজেলায় বাড়ি হলেও আমার সব পরিচিতি স্কুলকে ঘিরেই।’ ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া খাতুন বলে, ‘স্যার আমাদের গণিত পড়ান। না বুঝলে বারবার বুঝিয়ে দেন। কখনো রেগে কথা বলেননি। স্যার চলে যাবেন এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে।’ হরিদাসকাটি ইউনিয়নের কুচলিয়া ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য প্রণব বিশ্বাস বলেন, ‘শিক্ষক হিসেবে তিনি একজন আদর্শ।’

স্থানীয় সুন্দলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল লতিফ বলেন, ‘সৎ, নিষ্ঠাবান, কর্তব্যপরায়ণ একজন আদর্শ মানুষের উদাহরণ সত্যজিত বাবু। তিনি শিক্ষকসমাজের জন্য দৃষ্টান্ত।’ ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৯০ সাল থেকে সত্যজিৎ আমার সহকর্মী। কোনো দিন দেখিনি ঝড়-বৃষ্টি বা অসুস্থতার কথা বলে তাঁকে ছুটি নিতে। ঐচ্ছিক ছুটিও কাটাননি। তাঁকে ছাড়তে হবে—ভেবে খারাপ লাগছে। তার পরও তাঁকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় জানাতে চাই।’

সত্যজিত বিশ্বাস বলেন, ‘ঘণ্টা বাজার আগেই স্কুলে পৌঁছানোর মধ্যে আমি আনন্দ পাই। এ জন্য স্ত্রী আগে বকাঝকা করলেও এখন আমাকে সহযোগিতা করে। একসময় কর্মজীবী বন্ধুরা আমাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতেন। কর্তব্যনিষ্ঠার কারণে এখন তাঁরাও সম্মান করেন। আমি শিক্ষার্থীদের বন্ধু মনে করে আনন্দের সঙ্গে পড়াই। আজ বিদায়বেলায় বলব, সবার জন্য আমার দরজা খোলা। আমি সবার মাঝে বেঁচে থাকতে চাই।’

 

এদিকে গুণী এই শিক্ষকের প্রশংসায় রীতিমতো পঞ্চমুখ নেটিজেনরা। বিশেষ করে বর্তমানে এ সময়ে এ ধরনের ঘটনা লক্ষ্য করা আসলেই কঠিন। আর সেখানে নিজের জীবনের অধিকাংশ সময়টা বিদ্যালয় ও মানুষের জন্য কাটিয়ে দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেছেন সত্যজিত বিশ্বাস। এ ঘটনায় অনেকেই তাকে সত্যিকারের ‘নায়ক’ বলেও আখ্যায়িত করেছেন।

About

Check Also

সংস্কারের নামে ভয়াবহ দুর্নীতি-লুটপাট

সংস্কার ও উন্নয়নের নামে কয়েকগুণ বেশি ব্যয় দেখিয়ে হরিলুটের ব্যবস্থা করা হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *