পরিপূর্ণরূপে মানুষ হওয়ার জন্য শিক্ষার প্রয়োজন, শিক্ষা গ্রহনের কোন বয়স হয় না। মনীষীরা বলেছেন, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত শিক্ষার বিকল্প নেই। বিভিন্ন কারণে মানুষ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। পরবর্তীতে বিষয়টি নির্ভর করে তার মন-মানসিকতার উপরে, কেউ যদি চান তাহলে আবার শিক্ষাঙ্গনে ফেরত আসতে পারেন। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই এ সুযোগ রয়েছে। শিক্ষা একটি মানুষের জন্য অতি জরুরী বিষয় যেটা তার মৌলিক অধিকারের মধ্যে একটি। তেমনিভাবে এবার অর্থের অভাবে পড়াশুনা করতে না পারা হারুন নামে একজন চায়ের দোকানদার এসএসসি পাস করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাড়া ফেলে দিয়েছেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যতিক্রমী প্রতিষ্ঠান নিয়ে সারা দেশে আলোচিত ‘হারুন টি স্টল,। হারুন মিয়া স্কুল ছাড়ার পর ১৪ বছর ধরে চায়ের দোকান চালাচ্ছেন। তবে এবার উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে সবাইকে চমকে দিয়েছে বাংলাদেশ। তার অদম্য ইচ্ছার গল্পও ভাইরাল হয়েছে নেট দুনিয়ায়।শুক্রবার ময়মনসিংহের গৌরীপুরে ( Gauripur ) হারুনের চায়ের দোকান পরিদর্শন করেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। হারুন মিয়াকে বিশাল উপহার, এইচএসসি প্রোগ্রামের বই, শিক্ষা উপকরণসহ অন্যান্য উপহার তুলে দেন।
প্রতিনিধি দলে ছিলেন ময়মনসিংহ বাউবির ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক পরিচালক মাকছুদা জাহান, সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন ( Shahadat Hossain ), সহকারী পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম ( Md. Rafiqul Islam ), গৌরীপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের ( Gauripur Women’ Degree College ) সমন্বয়ক ফারুক হায়দার হোসেন , এইচএসসি প্রোগ্রাম সমন্বয়কারী রেজওয়ান হোসেন, আরকে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ( RK Government High School ) টিউটোরিয়াল সেন্টারের সমন্বয়ক মো. জাহিদুল হাসান।প্রতিনিধি দলে ড. হারুন মিয়ার ( Dr. Aaron Meyer ) মতো শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ইচ্ছা পূরণ করছেন বাউবি। এ সময় হারুনের খোঁজখবর নেন বাউবির উপাচার্য প্রফেসর ড. সৈয়দ ( Dr. Syed ) হুমায়ুন আখতার। প্রতিনিধি দল হারুনকে উচ্চ শিক্ষার জন্য সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাসও দেন।
হারুন মিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্ধমূল্যের চা, সেরা চা গ্রাহকদের সম্মাননা এবং নিষিদ্ধদ্রব্য অভিযানের জন্য ইতিমধ্যেই প্রশংসিত হয়েছেন। ব্যতিক্রমী এসব উদ্যোগের জন্য এই চায়ের দোকানটিও শহরে বিশেষ সুনাম পেয়েছে। এছাড়া চা বিক্রি করে তার আয়ও ভালো।কিন্তু অর্থের অভাবে পড়াশুনা করতে না পারার খারাপ অনুভূতি ছিল হারুনের। তবে হাল ছাড়েননি তিনি। চা পড়ার পর ২৪ বছর বয়সে এসএসসি পাস করেন হারুন। চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি ( February ) উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিপিএ-২.৮৬ পেয়ে এসএসসি পাস করেন হারুন।
জানা গেছে, হারুনের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর পৌর শহরের সতিশা গ্রামে। সংসারের অভাবের কারণে তিনি মাধ্যমিকে পড়ার সময় ২০১০ সালে স্কুল ছেড়ে দেন। সংসার সামলানোর জন্য ২০১৪ সালে পৌর শহরের কালিখলা এলাকায় চায়ের দোকান খোলেন তিনি। হারুন চা বিক্রির পাশাপাশি দোকানে বসে বিভিন্ন বই পড়তেন। তার পড়ার আগ্রহ দেখে শিক্ষক এমদাদুল হক ( Emdadul Haque ), আব্দুল মালেক ও সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম মিন্টুর ( Shafiqul Islam Mintur ) অনুপ্রেরণায় ২০১৯ সালে মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। চা বিক্রির পাশাপাশি রাতে পড়াশোনা করে এসএসসি পাস করেন।
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুল মালেক জানান, অষ্টম শ্রেণি থেকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবে। এই ক্ষেত্রে বয়সের কোন সীমাবদ্ধতা নেই। এই সুযোগে মাত্র ২৪ বছর বয়সে এসএসসি পাস করেন হারুন। আমি তার সব ভাল কামনা করি। হারুন মিয়া বলেন, টাকার অভাবে স্কুল ছেড়ে দিলেও হাল ছাড়িনি। স্বপ্ন ছিল স্বাবলম্বী হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর। এখন নিজের উপার্জনে পড়াশোনা করে এসএসসি পাস করেছি। চা বিক্রির পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই। লক্ষ লক্ষ স্নাতক।
হারুনের বাবা আব্দুল জব্বার ( Abdul Jabbar ) পেশায় সবজি বিক্রেতা। মা রহিমা খাতুন ( Rahima Khatun ) একজন গৃহিণী। হারুন ছয় ভাইবোনের মধ্যে পঞ্চম। এর মধ্যে চার ভাই-বোন বিয়ে করে আলাদা হয়ে যায়। ছোট বোন এ বছর এইচএসসি পাস করেছে। চা বিক্রি করা হারুন তার ছোট বোনের লেখাপড়ার খরচ চালায়। এছাড়া নিজের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
উল্লেখ্য, হারুন মিয়া চায়ের দোকানে মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে, বিভিন্ন পর্যায়ের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য করেছেন অর্ধমূল্যের চায়ের ব্যবস্থা। একসময় অভাবের কারণে সংসারের হাল ধরতে গিয়ে পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যেতে হয়েছিল। চায়ের দোকানে চালিয়ে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডের জন্য পেয়েছেন সামাজিক পুরস্কার। তার ইচ্ছা ছিল স্বাবলম্বী হয়ে স্বচ্ছলভাবে জীবন-যাপন করা। যদি সুযোগ হয় ফের পড়াশুনা শুরু করা। তিনি জানান, মহান আল্লাহতালার অশেষ রহমতে তিনি দুটি বিষয়ে সফল হয়েছেন।