ওসি প্রদীপ(OC Pradeep) এবং মেজর সিনহার(Major Sinha) মামলা টা নিয়ে দীর্ঘদিন চলছিল আলোড়ন। অবশেষে সেই বিচারকার্যের রায় পাওয়া গেল আজকে। তবে যে শুধুই রায় দিয়েছে আদালত তা নয়, বেরিয়ে এসেছে অনেক গোপন তথ্য। মেরিন ড্রাইভে(Marine Drive) ঘটেছিল কি সেদিন! প্রকাশ পেল মেরিন ড্রাইভের সেই দিনের পুরো ঘটনার প্রতিলিপি।
মেজর (অব.) সিনহা(Major (Retd.) Sinha) মো. রাশেদ খান(Md. Rashed Khan) হত্যা মামলায় কক্সবাজারের(Cox’s Bazar) টেকনাফের(Teknaf) বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত পরিদর্শক লিয়াকত আলী(Liaquat Ali) ও টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ দাসকে(OC Pradeep Das) মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত(The court)।
সোমবার (৩১ জানুয়ারি) বিকেল ৪টা ২১ মিনিটে কক্সবাজার জেলা(Cox’s Bazar District) ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল(Sessions Judge Mohammad Ismail) এ রায় ঘোষণা করেন।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা(Major Sinha) মোহাম্মদ টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ রোডের শামলাপুর চেকপোস্টে ৩১ জুলাই, ২০২০ রাতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। রাশেদ খান। ঘটনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ওই দিন কী ঘটেছিল তা জানা যায়।
হত্যার অভিযোগে তার বোন বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় টেকনাফ মডেল থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস(OC Pradeep Kumar Das), বাহারছড়া(Baharchhara) পুলিশ ফাঁড়ির(police outpost) পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।
২০২০ সালের জুলাই মাসে, সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান মেরিন ড্রাইভ রোড বরাবর পাহাড় ও সমুদ্রের বিভিন্ন মনোরম স্থান এবং প্রাকৃতিক দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করতে ‘জাস্ট গো’ নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করতে কক্সবাজারে আসেন। তার সঙ্গে ছিলেন তার দুই সহযোগী শাহেদুল ইসলাম সিফাত(Shahedul Islam Sifat) ও শিপ্রা দেবনাথ(Shipra Debnath)। এরই অংশ হিসেবে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের মারিশবুনিয়া এলাকার মুইন্যা পাহাড়ের(Muinya hill) ভিডিওচিত্র ধারণ করে মেরিন ড্রাইভ হয়ে কক্সবাজারে ফিরছিলেন তিনি। গত ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে শামলাপুর বাজারের কাছে এপিবিএন পুলিশ চেকপোস্টে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকতের(Liakat) গুলিতে সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান(Sinha Mohammad Rashed Khan) নিহত হন। এ সময় শাহেদুল ইসলাম সিফাতকে গ্রেপ্তার করা হয়। সিনহা যে হোটেলে ছিলেন সেখানে তল্লাশি চালানো হয়। হোটেল থেকে আটক করা হয় আরেক সহযোগী শিপ্রা দেবনাথকে(Shipra Debnath)। এ ঘটনায় সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন- টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাস, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত(Nanda Dulal Rakshit), কনস্টেবল সাফানুর করিম(Safanur Karim), কনস্টেবল কামাল হোসেন(Kamal Hossain), কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মামুন(Abdullah Al Mamun), সহকারী উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. -পরিদর্শক (এএস)। উপ-পরিদর্শক (এসআই) টুটুল(SI Tutul) ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা(Mohammad Mostafa)।
এ ঘটনায় টেকনাফ থানায় দুটি ও রামু থানায়(Ramu police station) একটি মামলা করেছে পুলিশ। সরকারি কাজে বাধা ও মাদক আইনে এসব মামলা করা হয়। সিনহার সহযোগী সাইদুল ইসলাম সিফাতকে টেকনাফ থানায় করা দুটি মামলার আসামি করা হয়। রামু থানায় মাদক আইনে দায়ের করা মামলায় সিনহার অপর সফরসঙ্গী শিপ্রা দেবনাথকে আসামি করা হয়।
টেকনাফ থানায় মামলা দায়েরের পর আদালত তদন্তভার র্যাবের কাছে হস্তান্তর করেন। একই সঙ্গে পুলিশের দায়ের করা তিনটি মামলার সবকটিই তদন্ত করতে র্যাবকে(RAB) নির্দেশ দেন আদালত।
তদন্ত কমিটিকে পরিদর্শক লিয়াকত(Inspector Liaquat) জানান, মারিশবুনিয়া গ্রামের কমিউনিটি পুলিশিং সেক্রেটারি নুরুল আমিন(Nurul Amin) তাকে ফোন করে জানান, ছোট ছোট বাতি জ্বালিয়ে ডাকাতরা পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাদক উদ্ধার অভিযান থেকে ফিরছিলেন লিয়াকত। নুরুল আমিন আবার ফোন করে বলেন, সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম পরা লোকজন গ্রামবাসীকে গুলি করেছে। সিলভারের গাড়িতে করে কক্সবাজার যাচ্ছেন তারা। নুরুল আমিনও কমিটির কাছে একই কথা বলেন। কমিটি বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ৩৫ পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, যাদের কেউই এ বিষয়ে জানতেন না। শুধু লিয়াকত ও নুরুল আমিন কথা বলেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, লিয়াকত এ খবর কারও সঙ্গে শেয়ার করেননি। এমনকি ওসি বা কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও নয়। খবরটি যাচাই করতে তিনি ইউপি সদস্য, চেয়ারম্যান বা স্থানীয় কাউকে ফোন করেননি। কোনো সহকর্মীকে সে কথা বলেনি। লিয়াকত কমিটিকে জানান, তিনি খবর যাচাইয়ের সময় পাননি। ইমাম জহির আলম মারিশবুনিয়ার মসজিদকে ডাকাত বলা হলে মাইকিং করতে নিষেধ করেন। তিনি বলেন, তারা সেনা সদস্য। পাহাড়ে যাওয়ার পথে তারা তার সাথে দেখা করে।
পাহাড় থেকে শামলাপুর চেকপোস্টে আসার আগে সিনহা একটি বিজিবি চেকপোস্টে থামেন। বিজিবি(BGB) সদস্যরা সিনহাকে স্যালুট জানান। সেখান থেকে ছয় কিলোমিটার আসার পর শামলাপুর চেকপোস্ট, যেখানে সিনহাকে গুলি করা হয়। এক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে সেনা চেকপোস্ট।
এপিবিএন সদস্যরা কমিটিকে জানান, লিয়াকত চেকপোস্টে এসে কিছু বলেননি। তিনি তল্লাশিচৌকির এসআই শাহজাহানকে ফোন করেছিলেন। তাছাড়া ফোনে ডাকাতির খবর পেলেও তার সঙ্গে পুলিশের একটি দল ছিল। কিন্তু কাউকে না জানিয়ে একাই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
লিয়াকত আলী সাক্ষ্য দেন যে ওসি প্রদীপ তাকে সিনহার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। যে বাড়ির বারান্দায় গুলি চালানো হয়েছিল সেখানে একজন পুলিশ অফিসারের হাতে ধরা পড়লে তিনি নিজের শটগানটি নিজের দিকে নিয়ে যান। ওসি প্রদীপ ঘটনাস্থলে এসে সিনহার বুকের বাম পাশে লাথি মারেন। সিনহা অসাড় হয়ে পড়েন।
সিনহা গুলিবিদ্ধ হওয়ার ২০ থেকে ২৫ মিনিট পর ঘটনাস্থলে আসেন প্রদীপ। এর আগে সিনহাকে হাসপাতালে(hospital) পাঠানো হয়নি। প্রদীপ আসার ২২ মিনিট পর সিনহাকে একটি ট্রাকে তুলে নেওয়া হয়।
কমিটি জানায়, হাসপাতালে যেতে অস্বাভাবিক বিলম্বের কারণে বিনা চিকিৎসায় সিনহার মৃত্যু হয়েছে।
পুরো ঘটনা প্রকাশ পেলেও মানুষের উত্তেজনা যেন কিছুতেই কমছে না। আদালত(The court) রায় দিয়েছে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে মানুষের মনে। তবে এখনো বাকি রয়ে গেছে কাজ। যতক্ষণ না কার্যকর হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের উত্তেজনা যেন কিছুতেই কমানো যাচ্ছে না। এখন দেখার বিষয় যে বিচার হতে ৬ মাস লেগে গেল সে বিচার কার্যকর হতে আর কতদিন সময় লাগে।