Friday , September 20 2024
Breaking News
Home / Countrywide / বিলাসিতায় ওড়ানো আনন্দে পুড়েছে গরিব এনামুলের স্বপ্ন

বিলাসিতায় ওড়ানো আনন্দে পুড়েছে গরিব এনামুলের স্বপ্ন

কথায় আছে কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ, কিন্তু এত বড় সর্বনাশ! যেখানে নতুন বছরের সবাই নব উদ্যোমে পরবর্তী দিনগুলো শুরু করার জন্য এগিয়ে চলে, দিনটিকে রাঙানোর জন্য নানান উৎসব পালন করে সেখানে উৎসবই কিনা একটা মানুষের কাল। সম্প্রতি এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে যেখানে নববর্ষের ফানুস পুড়িয়ে দিয়েছে এনামুলের ব্যবসা জীবনে দেখা সব স্বপ্ন। ছয় সদস্যের পরিবার নিজেই ছিলেন উপার্জনকারী। একবার ভেবে দেখেছেন মানুষের করা আনন্দ কিভাবে তার স্বপ্ন গুলোর উপর আঘাত হানল!

তিন দিন পর গত মঙ্গলবার কর্মস্থলে ফিরেছেন এনামুল হক। খ্রিষ্টীয় নববর্ষের দিনই অন্যান্য দিনের মতো কাজে ফেরার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু নতুন বছরের প্রথম প্রহরে মানুষের উল্লাস তাঁর জন্য কাল হয়ে আসে। নতুন বছরকে বরণ করে নিতে ওড়ানো এক ফানুস পুড়িয়ে দিয়েছে তাঁর ব্যবসার সম্বল, এখন তিনি ঋণের দায়ে দিশেহারা।

সেই কষ্টে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন, শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই তিন দিন কাজে আসেননি। যাত্রাবাড়ীতে একটি কাঁচাবাজার আড়তে ব্যবস্থাপকের কাজ করেন তিনি। বেতন ২১ হাজার টাকা। পরিবার নিয়ে থাকেন মাতুয়াইলে।
বাড়তি আয়ের জন্য চাকরির পাশাপাশি ছোটখাটো ব্যবসার পথ বেছে নিয়েছিলেন এনামুল হক। মাতুয়াইলে বাসার কাছে ১২ হাজার টাকা আগাম দিয়ে এক বছরের জন্য একটি বাসার ছাদ ভাড়া নিয়েছিলেন তিনি। সেখানে আম, টমেটো পরিবহনে প্লাস্টিকের ঝুড়ি রাখার গুদাম করা হয়। বাঁশের কাঠামোর ওপর প্লাস্টিকের ত্রিপলের ছাদ ও বেড়া দিয়ে নির্মিত সে গুদাম।

ঋণের মাধ্যমে বিনিয়োগ করা সাত লাখ টাকার সে গুদাম ফানুসের আগুনে জ্বলেছে। শেষ হয়ে গেছে বাড়তি আয়ের স্বপ্ন। এনামুল হক বলেন, ‘গুদামে ছয় লাখ টাকার ঝুড়ি ছিল। আর শেড (ছাউনি) করতে এক লাখ খরচ। চোখের সামনে দাউ দাউ করে মালগুলো (ঝুড়ি) জ্বলছে। কিছুই করতে পারলাম না।’

পরে স্থানীয় লোকজন ও ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট আগুন নেভায়। কিন্তু নেভার আগেই আধা ঘণ্টায় জ্বলে সব শেষ। তিনতলা সে ভবনের নিচে একটি সেলুনে কাজ করেন সজল কুমার শীল। ঘটনার দিন দোকানের সামনেই ছিলেন তিনি। রাত সোয়া ১২টার হঠাৎ ছাদে আগুন দেখেন। তিনি বলেন, ‘আশপাশের ভবনের অনেক মানুষই দেখেছে, একটি ফানুস এসে পড়ল ত্রিপলের ওপর। মুহূর্তেই আগুন লেগে গেল।’

মাত্র তিন মাস আগে এ ব্যবসা শুরু করেছিলেন মাতুয়াইলের এই ব্যবসায়ী। এনামুল হক বলেন, গুদামে সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো ঝুড়ি ছিল। প্রতিটির দাম ১০০ টাকার মতো। এসব ঝুড়ি কাঁচা সবজি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতেন।

গত দুই মাসে ১০ হাজার টাকা করে আয়ও করেছিলেন। সম্প্রতি ৫০০ ঝুড়ি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বাকি পাঁচ হাজার ঝুড়ি তিনজনের কাছে বিক্রি করে অগ্রিম টাকাও নেন। কিন্তু ক্রেতারা পণ্যগুলো নেওয়ার আগেই আগুনে পুড়ে গেছে।

এনামুল হক বলেন, ‘তাঁদের (ক্রেতাদের) কাছ থেকে নেওয়া টাকা ফেরত দিতে হবে। একজনকে ফেরত দিয়েছি। বাকি দুজন টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। এখন কাঁচা সবজির ভরা মৌসুম। ঝুড়ি কিনবে। তাদের বলছি, কয়েক দিন সময় দেন।’
ছয় সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী এনামুল হক। সন্তানদের লেখাপড়া, পিতামাতার চিকিৎসার খরচ, বাসাভাড়া, খাওয়ার খরচ—সবকিছু। তাই বাড়তি আয়ের পথ খুঁজছিলেন এনামুল হক। কাঁচাবাজারের সঙ্গে যুক্ত থাকায় ঝুড়ি বিক্রিটাকেই আয়ের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। ঋণ করে শুরু করেন ব্যবসা।

এনামুল হক বলেন, ‘আমার মূলধন খুব একটা ছিল না। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে তিন লাখের মতো টাকা আনছিলাম। আর সমবায় সমিতি থেকে ঋণ করছিলাম ৭৫ হাজার টাকা। মালটা (ঝুড়ি) বিক্রি করে আস্তে আস্তে দিয়ে দিতাম।’
ব্যবসায় নেমে এখন উল্টো বিপদ এনামুল হকের। বিনিয়োগের টাকাও খুইয়েছেন, ঋণও শোধ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আশা ছিল বাড়তি আয়। এখন আয়ের তুলনায় ঋণ শোধের পরিমাণটা বেশি হয়ে গেল। সমবায় সমিতিকে প্রতি সপ্তাহে দুই হাজার টাকা দিতে হয়, মাসে আট হাজার। ব্যবসাটা থাকলে চালায় যাইতাম সেই ঋণ। এখন তো সবই নষ্ট হয়ে গেছে।’

এনামুলের পরিবারের সবারই মন খারাপ। সরকারের পক্ষ থেকে কিছু পাবেন কি না, বারবার সে জিজ্ঞাসা করছিলেন প্রতিবেদককে।
খ্রিষ্টীয় নববর্ষের রাতে ফানুসের কারণে ঢাকায় সাতটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের উপসহকারী পরিচালক শাহজাহান শিকদার। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি মাতুয়াইলের। একমাত্র এ ঘটনাতেই ক্ষতিও হয়েছে।
বাকিগুলোতে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, মাতুয়াইল ছাড়া ধোলাইখালের আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের সহায়তা লেগেছে। বাকিগুলো স্থানীয় লোকজন মুহূর্তের মধ্যেই নিভিয়ে ফেলেছেন।

শুধু রক্ষা পাননি এনামুল হক। তিনি বলেন, ‘ফানুস গুরুত্বপূর্ণ (কোনো) জিনিস নয়। কিন্তু এটা মানুষ উড়াইতেছে, আনন্দ করতেছে। এতে তো মানুষের ক্ষতি হইতেছে। তবে সরকারের কাছে আমার দাবি, এটা ভবিষ্যতে যাতে (মানুষ) না ওড়ায়। এটা বন্ধ করে দেওয়া হোক।’

এনামুলের দাবি ফানুস ওড়ানো বন্ধ করার, যদিও অনেক কিছুই বারণ থাকে কিন্তু কে শোনে কার কথা নতুন বছরে। এ বছর বেশ কয়েকটি এমন খবর শোনা গেছে, এখন দেখার বিষয় ফানুস সম্পর্কে সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয় কিনা। যদিও প্রায় সময়ই শোনা যায় সরকার ফানুস উড়ানো বন্ধ করবে সাথে বাজি ফাটানো বন্ধ করবে, তবে নির্দেশ দিলেও সেগুলো পালন করে কজন। কেউ একবার ভেবে দেখে না তার ক্ষণিকের খুশির জন্য কিভাবে একজন গরিব মানুষের স্বপ্ন পুড়তে পারে।

About Ibrahim Hassan

Check Also

আ.লীগ ও তৃণমূল থেকে বিএনপিতে যোগদানের হিড়িক

নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও তৃণমূল বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে বিএনপিতে যোগদানের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *