সম্প্রতি প্রতারণার অভিযোগে দেশের বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করে প্রশাসন। আর ঐ সকল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি ইভ্যালি। চমকপ্রদ বিজ্ঞাপণের মাধ্যমের গ্রাহকদের আকৃষ্ট করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। দুর্ভাগ্যক্রমে এ ঘটনায় ফেঁসে গেছেন বাংলাদেশের নামি-দামি তারকারাও।
জানা গেছে, অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার মামলার সূত্র ধরে এরই মধ্যে তিন তারকা তাহসান খান, রাফিয়াত রশিদ মিথিলা ও শবনম ফারিয়াকে পুলিশ নজরদারিতে রেখেছে। যেকোনও সময় তাদের গ্রেফতার করা হবে বলে জানিয়েছেন ডিএমপি’র রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার সাজ্জাদুর রহমান। শুক্রবার (১০ ডিসেম্বর) সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা জানান।
হঠাৎ এমন খবরে অভিযুক্ত তিন তারকা তো বটেই, তাজ্জব বনে যান বেশিরভাগ মানুষ। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই ফিসফাসফিস করছেন এই বলে- ঘটনাটি উদ্দেশ্যমূলক। বিকাল নাগাদ বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে মুখ খোলেন দুই অভিযুক্ত তাহসান ও মিথিলা। দু’জনেই এমন মামলা ও খবরে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তবে তখনও নিশ্চুপ ছিলেন শবনম ফারিয়া। অবশেষে শুক্রবার (১০ ডিসেম্বর) দিবাগত মধ্যরাতে প্রতিবেদকের মুখোমুখি বসেন এই অভিনেত্রী। বলেন এই মামলা ও নজরদারি বিষয়ে বিস্তারিত-
সারাদিন আপনাকে পাওয়া যায়নি মুঠোফোনে বা সোশ্যাল হ্যান্ডেলে।
শবনম ফারিয়া: আম্মু আমার মোবাইলে সিজ করেছেন। উনার ধারণা, আমার হাতে মোবাইল থাকলে মাথা গরম করে উল্টা-পাল্টা পোস্ট দেবো। তবে দিনশেষে মনে হলো, আম্মুই ঠিক করেছেন। সারাদিন শান্তিতে ছিলাম।
তাহলে এখন (সাড়ে ১১টা) কেন সংযুক্ত হলেন!
শবনম ফারিয়া: বাসায় ফিরলাম মাত্র। সারাদিন শুটিং করেছি। আম্মু ঘুমে। এই ফাঁকে আরেকটি ফোন অন করে জাস্ট ফেসবুকটা অন করলাম। দেখলাম আপনারা সবাই আমাকে খুঁজছেন। আমারও মনে হলো- এভাবে চুপ না থেকে একটা প্রতিক্রিয়া দেওয়া দরকার। চুপ থেকে তো লাভ হয় না।
ভাবে কেন বলছেন। বোবারই তো নাকি শত্রু থাকে না!
শবনম ফারিয়া: আম্মু তাই মনে করেন। কিন্তু আমি তো ফল পেলাম না। ইভ্যালিতে জয়েন করেছি ঠিকই, কিন্তু তাদের কোনও প্রচারণায় আমি ছিলাম না। অথচ এখন মামলা হলো- আমাকে দেখে নাকি পণ্য অর্ডার করেছে! তাই প্রতারক হিসেবে মামলার আসামী হলাম।
বিষয়টি বিব্রতকর।
শবনম ফারিয়া: বিব্রতকর হলেও বাঁচা যায়। এটা অসম্ভব কষ্টের একটা বিষয়। তিল তিল করে নিজেকে চিনিয়েছি অভিনেত্রী হিসেবে। আর আজ একটা খোঁচায় প্রতারক হয়ে গেলাম। দেশের সকল গণমাধ্যম নিউজ ছেপে দিলো- নজরদারিতে আছি, গ্রেফতার হবো যে কোনও সময়! এ নিয়ে আপনাদের প্রতিও ক্ষোভ আছে আমার।
এখানে গণমাধ্যমের দায় খুব কম। নেই বললেই চলে। পুলিশ কর্তৃপক্ষ যা বলেছে, তাই প্রকাশ হয়েছে। এক অক্ষরও বেশি নয়।
শবনম ফারিয়া: কিন্তু আমার প্রশ্ন, শুনেছি মামলা হয়েছে ২ বা ৪ ডিসেম্বর। সেই খবরটি একযোগে প্রকাশ হতে এক সপ্তাহ সময় কেন লাগলো?
কর্তৃপক্ষ জানে। কিন্তু মামলার অভিযোগ খণ্ডাবেন কেমন করে?
শবনম ফারিয়া: যথেষ্ট প্রমাণ আছে খণ্ডানোর। প্রথম কথা হচ্ছে, এফআইআর অনুযায়ী উনি (মামলার বাদী) যে অর্ডার প্লেস করেছেন সেটা মে মাসের ২ তারিখ। আমি জয়েন করেছি এপ্রিল মাসের ৫ তারিখ। সো উনি আমাকে দেখে যে অর্ডার করেছেন সেটা মোটেও ঠিক না।
কিন্তু আমি নিজেই আপনার জয়েনিংয়ের খবরটি প্রকাশ করেছি ২ জুন! সেখানে আপনি জানিয়েছেন ১ জুন থেকে যোগদান করেছেন ইভ্যালির মিডিয়া ও কমিউনিকেশনস প্রধান হিসেবে। ৫ এপ্রিল বলছেন কেন!
শবনম ফারিয়া: সরি সরি সরি। আমি আসলে পাজলড হয়ে আছি। আপনি নিউজ প্রকাশ করেছেন ২ জুন। আর আমি অফিসে কাজ শুরু করি ৫ জুন থেকে। ১ জুন নিয়োগপত্র গ্রহণ করি।
তার মানে বলতে চাইছেন, অভিযুক্ত ব্যক্তি তার পণ্যের অর্ডার করেছেন মে মাসের ২ তারিখ। আর আপনি জয়েন করেছেন একমাস পর ৫ জুন। ফলে আপনাকে দেখে বা আপনার জনপ্রিয়তার মোহে তিনি তার অর্ডার করেননি।
শবনম ফারিয়া: একদমই তাই। তার অর্ডারের সঙ্গে আমার কোনও যোগসূত্র নাই। অথচ আমি আসামী! এখানেই তো বিষয়টি ক্লিয়ার।
কিন্তু পণ্য ডেলিভারির সময়সীমার ভেতরে তো আপনি সেখানে কর্মরত ছিলেন।
শবনম ফারিয়া: তাও বলতে পারেন না। প্রথম কথা, আমি জয়েনের আগের অর্ডার। দ্বিতীয়ত আমি ডেলিভারি সেকশনে কর্মরত ছিলাম না। তৃতীয়ত আমি ইভ্যালিতে জয়েন করার ১০ দিনের মাথায় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্দেশনা আসে কাস্টমারের টাকা সরাসরি ইভ্যালি নিতে পারবে না। চতুর্থত, ইভ্যালিতে জয়েন করার পর এই প্রতিষ্ঠানের কোনও প্রচারণায় ব্যক্তি শবনম ফারিয়া ছিলো না। আমি জয়েন করার সময় শর্তই দিয়েছি, অফিসের কাজের বাইরে আমি কোনও প্রমোশনে থাকবো না। ইভেন একটি ফেসবুক পোস্টও করিনি এই প্রতিষ্ঠানটিকে নিয়ে। শুধুমাত্র যমুনার ইনভেস্টমেন্টের খবরটা ছাড়া। যেটার পোস্ট প্রায় সকল আমজনতাই দিয়েছেন। কারণ, খবরটি সাধারণ মানুষ হিসেবেই আনন্দের ছিলো।
ইভ্যালি ছাড়লেন কবে? আপনার কাছ থেকে সেই উত্তর কিন্তু আজও মেলেনি। নাকি এখনও আছেন!
শবনম ফারিয়া: চাকরির শখ অনেক আগেই মরে গেছে। দুই মাসের মাথায় ছেড়ে দিয়েছি। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে।
ইভ্যালি তো তখনও চলছিলো। যমুনা যুক্ত হওয়ার খবর দিলো। সেসময় ছাড়ার কারণ কী? নাকি ভবিষ্যৎ দেখতে পারছিলেন।
শবনম ফারিয়া: অনেকটা তাই। দুই মাসেই আমি টের পেলাম- এখানে আমাকে দিয়ে আর হবে না। বিশেষ করে যমুনা ইনভেস্ট করার বিষয়টি আমাদের অনেক বুস্টআপ করে। কিন্তু দ্রুতই জানতে পারি, ওরা আসলে ইনভেস্ট করছে না। তখন আমার বস আরিফ আর হোসাইন ভাইকে বললাম- কী হচ্ছে এসব? তিনি বললেন, ‘চলো আমরা ছাড়ি’। আমিও ছেড়ে দিলাম চোখ বন্ধ করে। কারণ এরমধ্যে ইভ্যালির অনেক টাকা ডিউ পড়ে গেল বিভিন্ন চ্যানেলে। এসব ফোন আবার আমার কাছে আসতো। ট্যাকেল দিতে হতো। এমনিতেই নতুন মানুষ, এরমধ্যে পাওনাদারের চাপ। তাও আবার সব মিডিয়া আমাকে ডিল করতে হচ্ছে। আসলে বুঝে উঠতে পারিনি কিছু। ভাবলাম, এসব বাদ। আমার অ্যাকটিংটাই প্রপারলি করি।
অ্যাকটিংটা তো ভালোই চলছিলো। ‘দেবী’ টু ‘ফ্যামিলি ক্রাইসিস’; নাটক-সিনেমা দুটোতেই সমান্তরাল ছিলেন। ইভ্যালিতে যুক্ত হলেন কোন মোহে বা কী ভেবে?
শবনম ফারিয়া: আমি কেন জয়েন করলাম- দেখলাম তাহসান খান এটার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। তিনি বাংলাদেশের তিনজন সুপারস্টারের একজন। আরও আছেন মিথিলা আপু। তিনিও বুদ্ধিদীপ্ত শিক্ষিত মানুষ। এরপর দেখলাম এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের টাইটেল স্পন্সর। র্যাবের সিনেমা হয় ওদের স্পন্সরে। গভর্মেন্টের একটি ইভেন্ট শুনলাম কয়েক কোটি টাকা দিয়ে স্পন্সর করছে প্রতিষ্ঠানটি। তার মানে আমি কী বুঝবো? এটাই ক্লিয়ার, এই কোম্পানি ভালো, স্ট্রং ও ক্রেডিবল।ভিত্তি বা ব্যাকআপ শক্ত না হলে তো এই কাজগুলো একসঙ্গে কেউ করতে পারে না।
অতঃপর মোটা অংকের অফার পেলেন, জয়েন করে ফেললেন-
শবনম ফারিয়া: ঠিক তাও নয়। অতোটা লোভী বা বোকাও তো নই আমি। এখন যতটা হয়ে গেছি! তখন আমার ভিশনটা ছিলো সুদূরপ্রসারী ও স্পষ্ট। তখন ভাবতাম, অভিনয়ের পাশাপাশি একটা কিছু করা দরকার। কারণ আমাদের দেশে অভিনয়ের ক্ষেত্রে কী হয়, একটা বয়সের পর দেখা যায় ক্যারিয়ারটা ওরকম থাকে না, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে। তো আমি তখন মাস্টার্স করছিলাম মিডিয়া কমিউনিকেশনে। ভাবলাম একটা এক্সপেরিয়েন্সও হলো। দেন অন্য কোথাও যাবো। সঙ্গে উত্তম প্রস্তাব। জয়েন করে ফেললাম।
অবশেষে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাটি ভেস্তে গেল দুই মাসের মাথায়! কিন্তু এরপর তো সব ঠিকঠাকই চলছিলো। অভিনয়ে নিয়মিত হলেন। এরমধ্যে আজ (শুক্রবার) সকালে ঘুম থেকে উঠে জানলেন- মামলা, নজরদারি আর গ্রেফতারের খবর। নাকি আগেই জানতেন। ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছেন।
শবনম ফারিয়া: একদমই জানতাম না। প্রশ্ন তো এখানেই, ২ ডিসেম্বরের ঘটনা ১০ ডিসেম্বর পত্রিকায় প্রকাশ হলো কেমন করে? এর পেছনে অন্য কারণ থাকতে পারে; আমার মনেহয়।
তাহসান-মিথিলাও একই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কারণটি স্পষ্ট করেননি। আপনার কী মনে হয়?
শবনম ফারিয়া: কিছুই জানি না, কারণ কী হতে পারে। বাট এটা বুঝি, এই মামলায় আমাকে ইনভল্ব করার কোনও মানে নেই। পুরাই ভুয়া। মামলার এফআইআর-এর সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা নেই। আমাকে দেখে যে তিনি অর্ডার করেছেন- সেটা মিথ্যে। আমাকে হেরাস করার জন্যই এই মামলা।
কিন্তু মামলার খবরটি তো আজ জানাজানি হলো। কর্তৃপক্ষ আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে? বা আপনি করেছেন কারও সঙ্গে?
শবনম ফারিয়া: আমি জানি না। কারণ আমার ফোন সারাদিন বন্ধ ছিলো। সকালেই আম্মু নিয়ে গেছে ফোন।
নেক্সট স্টেপ কী ভাবছেন। পুলিশ নজরদারিতে থেকে তো আর হাতগুটিয়ে বসে থাকা যায় না!
শবনম ফারিয়া: কিছুই ভাবছি না। এটা স্টুপিডিটি ছাড়া কিছু না। আমাকে হেরাস করার জন্য এটা করেছে। আমি ইভ্যালির মালিকও না। আমার তো ইভ্যালির বিরুদ্ধেও মামলা করার সুযোগ আছে। কারণ, এখানে জয়েন করার পর কোনও স্যালারি পাইনি। উল্টো টাকা আত্মসাতের মামলা খেয়ে বসে আছি!
বাংলায় এটাকে সম্ভবত বলে- আম ও ছালা দুটোই গেল!
শবনম ফারিয়া: যে এই মামলাটা করেছে তার বিরুদ্ধেও হেরাসমেন্টের মামলা করতে পারি। কারণ, তার অভিযোগের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা নেই। বাট এখন পুলিশ যেহেতু বলছে তদন্ত করছে, নজরে রাখছে- দেখা যাক তারা কী পান। আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তো খালি খালি হেরাস করবে না আমাকে।
আমি আরেকটা বিষয়ে খুব অবাক হলাম। পত্রিকাগুলো লিখলো- আমাকে নাকি যে কোনও মুহূর্তে গ্রেফতার করা হতে পারে! এটা কেমন কথা! এই কথা আদৌ কেউ বলেছে বলে আমার মনে হয় না।
নিশ্চিত থাকুন, কর্তৃপক্ষ এটা না বললে পত্রিকায় এভাবে লেখার সুযোগ থাকে না।
শবনম ফারিয়া: তাহলে আর আমার কি বলার আছে।
তবুও যদি কিছু বলার থাকে-
শবনম ফারিয়া: দেখেন দেশে অনেক কিছু হয়। এখানে একটা খবর সরাতে আরেকটা খবর লাগে! আমাদের নেগেটিভ জিনিষের প্রতি আগ্রহ অনেক। আর সেই ঘটনার সঙ্গে তারকা থাকলে তো কথাই নেই; দাউ দাউ করে জ্বলে। তো আমার মনে হয় পুরো ঘটনাটাই হেরাসমেন্ট। এই মামলায় ভ্যালিড অন্তত একটা অভিযোগ থাকলেও মনকে বুঝাতে পারতাম।
আপনি কি সকাল থেকে আত্মগোপনে আছেন! নজর যেন না পড়ে…
শবনম ফারিয়া: কেন আত্মগোপনে থাকবো! কী এমন করেছি আমি? কে কই আছি বের করা দুই মিনিটের বিষয়। আমি স্বাভাবিক আছি, রাতে বাসাতেই আছি, দিনে শুটিং করছি। শুধু আম্মু ফোনটা সিজ করেছে। এটাই কষ্ট।
উল্লেখ্য, প্রতারণার মাধ্যমে তিন লাখ ১৮ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ জানিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম গুণী এই তিন তারকা এবং ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনসহ মোট৯ জনের বিরুদ্ধে থানায় একটি মামলা দায়ের করেন সাদ রহমান নামে এক ভুক্তভোগী। এ মামলায় এরই মধ্যে গ্রেপ্তারের পর কারাগারেই দিন কাটছে রাসেল ও শামীমা দম্পতির। তবে এ ঘটনায় গ্রাহকদের জন্য সরকারের কিছুই করার নেই বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছে প্রশাসন।